অসহযোগের দিকে মোড় নেবে চলমান আন্দোলন

টানা ৪৭ দিন ধরে চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল ঘোষিত অনির্দিষ্টকালের অবরোধ কর্মসূচি। দফায় দফায় আসছে হরতাল। পাবলিক পরীক্ষা, শহীদ দিবস এমন কি নিজের ছেলের মৃত্যুতেও অবরোধ কর্মসূচি শিথিল করেননি বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধী জোট নেতা খালেদা জিয়া। আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারের প্রতি বারবার সংলাপের আহ্বানও জানিয়েছে বিরোধী জোট। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নাগরিক সমাজ ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বানের প্রতিও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। দলটির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমেই সমাধান চায় বিএনপি। অবরোধ অব্যাহত রাখলেও সংলাপের ব্যাপারে সরকারের তরফে সাড়া প্রত্যাশা করে কিছুদিন অপেক্ষা করবে ২০ দল। নির্দিষ্ট সময় সে অপেক্ষার পর অসহযোগের দিকে মোড় নেবে চলমান আন্দোলন। সে অপেক্ষা দুই সপ্তাহের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম। নেতারা জানান, শান্তিপূর্ণ একটি সমাধানের আশায় এখনও সর্বোচ্চ ইতিবাচক মানসিকতা দেখানো হচ্ছে বিএনপির তরফে।

প্রতিদিন বিরোধী জোটের নেতাকর্মীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ সমাধানের নীতিগত সিদ্ধান্তে অটল বিএনপি। তবে পরিস্থিতির উত্তরণ না হলে আন্দোলনে গতি বাড়ানোর বিকল্প থাকবে না। এদিকে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার তিনদিন আগে থেকেই নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রথমে অবরুদ্ধ এবং পরে স্বেচ্ছা অবস্থান করছেন বিরোধী জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। অবরোধ এবং হরতাল কর্মসূচির কারণে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে জাতীয় জীবনে। স্থবিরতা নেমে এসেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। প্রতিদিনই মরছে মানুষ। একদিকে চলছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অন্যদিকে যানবাহনে অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্ক। কিন্তু এতকিছুর পরও চলমান পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক সঙ্কট হিসেবে এখনও স্বীকার করেনি সরকার। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির ভেতরেও আন্দোলনে শিথিলতা দেখায়নি বিরোধী জোট।

এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন সংলাপের জন্য চিঠি দিয়েছেন সরকার ও বিরোধী জোটের শীর্ষ নেত্রীর কাছে। বাংলাদেশ সফর করে সরজমিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ)-এর মানবাধিকার বিষয়ক সংসদীয় উপ-কমিটির একটি প্রতিনিধি দল। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ নাগরিক ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিটি আহ্বানকে স্বাগত জানানো হয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান সঙ্কট যে একটি রাজনৈতিক সঙ্কট তা এখন আন্তর্জাতিক মহলও উপলব্ধি করছে। তারা বুঝতে পেরেছে বিরোধী জোট যে দাবিতে আন্দোলন করছে তার প্রতি দেশের সর্বাধিক মানুষের সমর্থন রয়েছে। ফরে তারা সরকারকে সংলাপ-সমঝোতার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। সরকারের উপর যে চাপ তৈরি হচ্ছে তা বিরোধী জোটের রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণেই।

এতে প্রমাণ হয়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এ ব্যাপারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সারওয়ারী রহমান বলেন, সরকার যতই অস্বীকার করুক চলমান পরিস্থিতির কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক সঙ্কট। আমরা যে প্রেক্ষাপটে আন্দোলন করছি তার প্রতি দেশের মানুষের সমর্থন আছে। এ জন্যই সরকারের তরফে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আন্দোলন চলছে। এই যে, রাজনৈতিক সঙ্কট- এটা এখন সরকার ছাড়া সবাই উপলব্ধি করছে। দেশের নাগরিক সমাজের পর এবার আন্তর্জাতিক মহল এ ব্যাপারে সংলাপে বসতে সরকার ও বিরোধী জোটের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটা আমাদের আন্দোলনের একটি ইতিবাচক অগ্রগতি।

আমরা সুনির্দিষ্ট ইস্যুতে সংলাপের জন্য সব সময়ই প্রস্তুত আছি। এখন সরকার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেই হয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক কূটনীতিক ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, দেশে এখন একটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। এ অনিশ্চয়তাই জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিক সঙ্কটের। এ সঙ্কট দেশের মানুষ, নাগরিক সমাজ এমনকি আন্তর্জাতিক মহলও উপলব্ধি করতে পেরেছেন, দেখতে পাচ্ছেন। এটাকে আমরা আন্দোলনের একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে অবশ্যই বিবেচনা করি। তিনি বলেন, সরকার স্বীকার না করলে কি হবে- অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। সঙ্কট যদি না থাকবে তবে সন্ত্রাস, খুনোখুনি ও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড হচ্ছে কেন? মানুষ কেন বাসায় ঘুমোতে পারছে না? তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীরা। এ পরিস্থিতি এক পর্যায়ে চরমপন্থার জন্ম দিতে পারে। ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- হিংসা-সন্ত্রাস, দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার-নির্যাতন ও যুদ্ধ ঘোষণা করে শান্তি আসবে না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তি আসবে।

বিএনপি এটা উপলব্ধি করে বলেই নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সরকার এটা উপলব্ধি না করলে জাতির জন্য দুর্ভাগ্য হবে। তাই সমঝোতার এ আহ্বান বৃথা যেতে দেয়া উচিত নয়। আমি বিশ্বাস করি, সরকারের বোধোদয় হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র জনসংহতি সমিতির সঙ্গে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই সংলাপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর বিএনপি তো একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এদিকে স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এক যৌথবিবৃতিতে বলেছেন, জনগণের ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, মনবাধিকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশের জনগণের যৌক্তিক আন্দোলনের প্রতি সাড়া দিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী, ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্রুত গঠনমূলক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণগ্রেপ্তারের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশ্ব সম্প্রদায়ের আহবান ও গণদাবি অগ্রাহ্য করলে সরকারের পরিণতি ভয়াবহ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *