তিস্তা নিয়ে তার ওপর আস্থা রাখতে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগের দিনই ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমস্যা আছে, আপনাদেরও আছে। আমি হাসিনা দি’র সঙ্গে আলোচনা করব। আমাদের ওপর ছেড়ে দিন, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।’ গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সে আলোচনা হয়। কিন্তু প্রত্যাশিত চুক্তির ব্যাপারে কোন সুখবর মিলেনি। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, বৈঠকে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। ঢাকা-দিল্লির মধ্যে চুক্তিটি সম্পাদনে উদ্যোগ নেয়া হলে মমতা সহযোগিতা করার চেষ্টা করবেন।
বৈঠকে ভারতে ইলিশ রপ্তানির বাধা নিরসনের বিষয় মমতা তুলেছিলেন। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পানি এলে ইলিশ যাবে। বৈঠক সূত্র জানায়, পানির বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, নদীতে জলের সমস্যা, সেদিকটিও বিবেচনা করতে হবে। রাতে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফর নিয়ে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশন যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিস্তা ইস্যুতে মমতার আলোচনার দুটি লাইন রয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, তিস্তা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। এখানে কিছু কারিগরি ইস্যু রয়েছে উল্লেখ করে মমতা বলেছেন, এটি এমনভাবে সমাধান করতে হবে যাতে ওই নদীর ওপর নিভর্রশীল জনগণের কল্যাণ সুরক্ষা হয় এবং উভয় পক্ষ উপকৃত হয়। এদিকে বিষয়টি নিয়ে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর তিস্তা নদীর পানি বন্টন চুক্তি করতে যখন দুই পক্ষ সম্মত হয়, তখন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব টেকনিক্যাল বা কারিগরি ইস্যু বিবেচনায় নিয়েই তা চূড়ান্ত করা হয়। এখানে নতুন করে ‘কিছু টেকনিক্যাল ইস্যু’ রয়েছে বলার অর্থ হচ্ছে সময় হরণ করা।
উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে তিস্তায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখব: বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু সমস্যার সমাধানে তার রাজ্য সরকার ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করেছেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি বলেছেন, আমরা বাংলাদেশকে ভালবাসি এবং দেশটির স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করি। এটি আমাদেরও দেশ, অতএব পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থ রক্ষা করে যথাশিগগির সম্ভব আমরা তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে ইতিবাচক ভূমিকা রাখব। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব একেএম শামীম চৌধুরী এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তথ্য উপদেষ্টা বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রথমে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে দুই নেতা প্রায় আধা ঘণ্টা একান্ত বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আন্তরিক পরিবেশে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অর্থাৎ ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রথম বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হতে পরামর্শ দেন।
মমতা বলেন, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ উভয়ের স্বার্থেই এই চুক্তি হবে। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই। এটি ইতিবাচকই হবে। স্থলসীমানা চুক্তি (এলবিএ) সম্পর্কে মমতা বলেছেন, আগামী ২৩শে ফেব্রুয়ারি লোকসভার অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এই অধিবেশনেই বিলটি পাস হবে। ইতিমধ্যেই বিলটি লোকসভায় পেশ করা হয়েছে। মমতা বলেন, যদিও বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার, তথাপি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখব। তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা মতৈক্যে পৌঁছেছি এবং লোকসভার আসন্ন অধিবেশনে বিলটি পাস করানোর জন্য আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। ফলে এ মুহূর্তে চুক্তি অনুমোদনের কোন প্রয়োজন নেই এবং লোকসভার আসন্ন অধিবেশনে এটি বাস্তবায়ন হবে। এদিকে বিডি নিউজ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এ সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের ভিত্তি তৈরি হলো। ইকবাল সোবহান বলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে বড় বোনের মতো দেখেন। প্রধানমন্ত্রীও তাকে ছোট ে বোনের মতো দেখেন। তিস্তা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি পজিটিভ ইন্ডিকেশন দিয়েছেন, কোন টাইমফ্রেম দেননি।
উপদেষ্টা বলেন, প্রধানমন্ত্রী মমতাকে ছিটমহলের মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ছিটমহলে গেছেন এবং তাদের দুর্ভোগ নিজ চোখে দেখেছেন।’ বৈঠকে জঙ্গিবাদের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছি কি না- জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেন, ‘জঙ্গি তৎপরতা কোন দেশের জন্য মঙ্গলের না- এ বিষয়ে দুজনই একমত প্রকাশ করেছেন।’ বাংলাদেশ ও পশ্চিমঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক আরও হৃদ্যতাপূর্ণ করার ওপর জোর দিয়ে মমতা বলেন, এই সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে যে ভূমিকা রাখা দরকার তিনি তা করবেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মরণ করে এক সময়ের এই কংগ্রেস নেত্রী বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি অনেক ছোট ছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানগুলো নিয়মিত শুনতেন তিনি। বাংলাদেশ অমর একুশের অনুষ্ঠানে অতিথি করায় নিজেকে ধন্য মনে করছেন বলে মমতা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়গুলোও বৈঠকে আলোচিত হয়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন মমতা। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সাংস্কৃতিক উৎসবের জন্য একটি কমিটি করে দেয়ার কথাও বলেন তিনি।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে এজন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানান ইকবাল সোবহান। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রচার এবং চলচ্চিত্র প্রচারে উদ্যোগ নেবেন বলেও আশ্বাস জানান মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ঢাকায় প্রথম সফরে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদেরও নিয়ে এসেছেন মমতা, যার মধ্যে রয়েছেন মুনমুন সেন, গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎ, দেব, নচিকেতা, ইন্দ্রনীল। রাজ্যের মন্ত্রিসভার আগামী বৈঠকেই অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতায় ‘বঙ্গভবন’ তৈরিতে বাংলাদেশ সরকারকে জমি দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে বৈঠকে উপস্থিত তার কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেন মমতা। মমতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার এবং বঙ্গভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও জানান ইকবাল সোবহান। কলকাতা থেকে আগরতলা সরাসরি বাস চলাচলের বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পর সোনারগাঁও হোটেলে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান মমতা।