মাকড়সার তৈরি সূক্ষ্ম তন্তু বা জালকে এত দিন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্ত প্রাকৃতিক বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক এবার শামুকজাতীয় একধরনের প্রাণীর দাঁতের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা দাবি করছেন, এই প্রাণীর দাঁতই সবচেয়ে শক্ত প্রাকৃতিক উপাদান। গতকাল বুধবার রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞান সাময়িকী ইন্টারফেস গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।
শামুকের মতো প্রাণীগুলো ইংরেজিতে লিম্পেট নামে পরিচিত। এদের দাঁতের গঠন এত শক্তিশালী যে সেগুলোর অনুকরণে তৈরি উপাদান মোটরগাড়ি, নৌকা ও উড়োজাহাজ তৈরির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের অধ্যাপক আসা বারবার ওই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, এত দিন পর্যন্ত তাঁরা মাকড়সার জালকেই সবচেয়ে শক্তিশালী জৈব উপাদান হিসেবে গণ্য করতেন। কারণ, এটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বুলেটপ্রুফ পোশাক থেকে শুরু করে কম্পিউটারের মতো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এখন তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, লিম্পেটের দাঁত আরও বেশি শক্তির নমুনা দেখাতে পেরেছে।
বারবার ও তাঁর সহযোগীরা লিম্পেটের দাঁতের গাঠনিক উপাদান এবং আচরণ নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ চালান। এ ক্ষেত্রে তাঁরা পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি (অ্যাটমিক ফোর্স মাইক্রোস্কোপি) প্রয়োগ করেন। এতে দেখা যায়, প্রাণীটির দাঁতে গ্যেথাইট নামের একটি শক্ত খনিজ প্রোটিন উপাদান রয়েছে। লিম্পেটের শারীরিক বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওই উপাদানটি তৈরি হতে থাকে।
বারবার বলেন, পাথুরে ওপরিতলে চলাফেরা ও টিকে থাকার জন্য লিম্পেটের অত্যন্ত শক্তিশালী দাঁতের প্রয়োজন হয়। খাবার সংগ্রহের জন্য এরা এসব দাঁত দিয়ে জোয়ারের সময় শেওলা অপসারণ করে। এরা পাথর থেকে খাবার ছাড়িয়ে মুখে নেয় এবং শক্ত পাথুরে উপাদান চিবিয়ে গিলে নেওয়ার উপযোগী করে নেয়।
একটি স্থিতিস্থাপক যৌগিক উপাদান তৈরি করার জন্য যে আকারের তন্তু প্রয়োজন, তা গ্যেথাইটের মধ্যে আছে। লিম্পেটের দাঁতে যে তন্তুজাতীয় কাঠামো পাওয়া যায়, তা ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে উচ্চমানের প্রকৌশল সামগ্রী তৈরি করতে পারবেন—এমনটাই আশা করছেন বারবার। এসব সামগ্রীর মধ্যে ফর্মুলা ওয়ান রেসিং কার বা দ্রুতগামী মোটরগাড়ি, নৌযান ও উড়োজাহাজের কাঠামো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বারবার আরও বলেন, একজন প্রকৌশলীর জন্য জীববিদ্যা হচ্ছে অনুপ্রেরণার বড় উৎস। লিম্পেটের দাঁতগুলো অতি সূক্ষ্ম তন্তুর তৈরি। একটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে এগুলো সজ্জিত থাকে। মানুষের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের নকশা তৈরির সময় ওই সজ্জা বা কাঠামো অনুসরণ করা যেতে পারে। তন্তুগুলো আয়রনভিত্তিক খনিজ উপাদান গ্যেথাইটের সমন্বয়ে তৈরি। এগুলোর কাঠামো অনুসরণ করে শক্তিশালী প্লাস্টিক তৈরি করা যেতে পারে।
লিম্পেটের দাঁতগুলো লম্বায় এক মিলিমিটারের চেয়েও কম। কিন্তু তার পরও সেগুলো বিস্ময়কর শক্তি ধারণ করে। গবেষণাগারে সংরক্ষিত এসব দাঁতের নমুনা বিশ্লেষণ করে দেখেছেন বারবার ও তাঁর সহযোগীরা। একেকটি দাঁতের মাঝখানের অংশ মানুষের চুলের চেয়ে প্রায় শত গুণ সরু। এগুলো মাকড়সার জালের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি শক্তিশালী। মানুষের তৈরি শক্তিশালী কেভলার তন্তুর চেয়েও লিম্পেটের দাঁতের শক্তি বেশি। কেভলার তন্তুর শক্তি কার্বন তন্তুর প্রায় সমান। অধ্যাপক বারবার বলেন, খনিজ তন্তুর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো অত্যন্ত সরু। ফলে এতে কোনো ধরনের গর্ত বা ফাটল থাকার সম্ভাবনা কমে যায়। এ ধরনের ত্রুটি থাকলে সার্বিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। সাধারণত কোনো কিছু বড় আকারে তৈরি করলে তাতে ত্রুটি থাকার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। আর এসব ত্রুটির কারণে সার্বিক কাঠামোর মান নষ্ট হয়।
সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিভেন হকিংস বলেন, লিম্পেটকে সমুদ্র উপকূলে পাথর খুঁড়ে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। এ কারণেই এদের দাঁত এত বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে।
সূত্র: রয়টার্স ও বিবিসি