টাইগারদের জন্য শুভ কামনা

মাঠের যে দিকটায় লাল ইটের পুরনো গির্জাটি দাঁড়িয়ে, সেখানে প্রতিদিন মঙ্গলঘণ্টা বাজিয়ে শহরবাসীকে ‘শুভ সকাল’ জানানো হয়। ক্যানবেরার মানুকা অঞ্চলের এটা বহুদিনের ঐতিহ্য। সেন্ট পলস চার্চের আটটি ঘণ্টা একসঙ্গে বেজে উঠে আজ শুধু মানুকায় নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদেরও ঘুম ভাঙাবে। বিশ্বকাপ অভিযান শুরুর আফগানদের বিপক্ষের ক্ষণটি যদি শুভ না হয় তাহলে কি আর দেড় মাসের এ ক্রিকেটযজ্ঞে মন থাকবে। তাই ১১ বাংলাদেশির সঙ্গে আছে আজ ১৬ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা। তবে যার শুভেচ্ছা সবচেয়ে বেশি প্রেরণা দিতে পারত, মাশরাফির সেই তিন মাসের ছোট্ট ছেলেটিই যে হাসপাতালে। ‘ওর জন্য মনটা খারাপ…। ওর হাসিমুখই যে আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা। তার পরও দেশের মানুষের ভালোবাসা আমাদের সঙ্গে আছে। তাদের মুখে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব আমাদের।’ আফগানিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে সবাই যখন প্রশ্ন করছে_ বাংলাদেশ চাপে আছে কি-না? তখন অধিনায়ক মাশরাফি বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে মাইক্রোফোন শক্ত করে ধরে শুনিয়েছেন ‘কিসের চাপ, সবাই মুখিয়ে আছে আফগানিস্তানের সঙ্গে এ লড়াইয়ের জন্য। দেখবেন কাল বাংলাদেশের সমর্থকরা গ্যালারি ভরে সারপ্রাইজ দেবে সবাইকে।’ ভেতরের অনুভূতিগুলো চাপা না রেখে মুশফিকও জানিয়েছেন তার মনের কথাগুলো। ‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, দলের প্রত্যেক ক্রিকেটার কিছু একটা করার অপেক্ষায় আছে। প্রস্তুতি ম্যাচে ভালো কিছু হয়নি বোধহয় বিশ্বকাপে ভালো কিছু হবে বলে…। এটি একান্তই আমার নিজের বিশ্বাস। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভালো কিছুর আগে দলের ড্রেসিংরুমে যে পরিবেশ থাকে, সেটাই এখন দেখছি আমি।’ টাইগারদের জন্য শুভ কামনা

অনেকটা পরীক্ষার আগের রাতের বইয়ের পাতাগুলো আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেওয়ার মতো এদিন সবাই নেটে নিজেদের প্রিয় শটগুলো খেললেন। তামিম যেমন ডাউন দ্য উইকেটে এসে পেসারদের তুলে মারলেন, তেমনি সাকিব সুইপ খেললেন কয়েকজন স্পিনারকে। বোলিং স্পেলটা শেষ হওয়ার পর তাইজুলও প্যাড পরে নেমে গেলেন নেটে। নাসির লং অন আর লং অফ বলে কোচকে তার শটগুলো যাচাই করতে বললেন। তবে সব অস্ত্রই তো আর যুদ্ধের আগে মহড়ায় ভোঁতা করা যায় না, তাই এদিন পেসারদের বিশ্রাম দিয়ে চার্জে রাখলেন কোচ হাথুরুসিংহে। ঐচ্ছিক অনুশীলনে মাশরাফি না থাকলেও এসেছিলেন শুধুই সাংবাদিকদের সঙ্গে অফিসিয়াল কথা বলার জন্য। যেখানে তাকে সেই বিব্রতকর প্রশ্নগুলোই শুনতে হয় অস্ট্রেলীয় সাংবাদিকদের কাছে। তোমরা তো আফগানিস্তানের কাছে হেরেছিলে, তোমরা কি মনে কর, ক্রিকেট ঘিরে বাংলাদেশিদের যে আবেগ তার মর্যাদা তোমরা ক্রিকেটাররা দিতে পেরেছ? ইঙ্গিত স্পষ্ট। দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপে নামা। ‘আমরা আফগানিস্তানের সঙ্গে ওই একটিই ওয়ানডে খেলেছি। তারপর টি২০ ম্যাচে কিন্তু ওদের হারিয়েছি আমরা। ওরা অবশ্যই ভালো দল। তবে আমরা তৈরি আছি আমাদের মতো করে। গত এক সপ্তাহে প্রত্যেকে দারুণ অনুশীলন করেছে।’

আফগানিস্তানকে নিয়ে একটি সফট কর্নার রয়েছে অস্ট্রেলীয়দের। তাদের মনে দাগ কেটে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী ক্যাম্পে বেড়ে ওঠা মোহাম্মদ নবীদের গল্পটিই। কিন্তু সেই গল্প আর স্পর্শ করে না এখন নবীদের। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এসে নবী বরং শোনালেন তাদের গত তিন মাসে অস্ট্রেলিয়ায় অনুশীলন করার দিনগুলোর কথাই। ‘অস্ট্রেলিয়ার কন্ডিশন বাংলাদেশিদের চেয়ে আমরা ভালো জানি। এখানে আমরা গত কয়েক মাস অনুশীলন করেছি। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারতের মতো দলগুলোর বিপক্ষে আমরা খেলেছি। অভিজ্ঞতায় হয়তো বাংলাদেশ এগিয়ে, তবে মনে রাখবেন খেলাটি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়। এখানে আমাদের পেসাররা ভালো করার রেসিপি জানেন।’ সামনে থেকে কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল নবী বোধহয় ভুলে গেছেন, যে ম্যাচে ফতুল্লায় বাংলাদেশকে তারা হারিয়েছিল সেই ম্যাচটিতে খেলেননি সাকিব, তামিম, মাহমুদুল্লাহর মতো ক্রিকেটার। তাই প্রশ্নটি করতেই হলো_ ‘যে বাংলাদেশ দলকে হারিয়েছিলেন আপনারা সেই দলটির সঙ্গে বর্তমান দলটির পার্থক্য নিশ্চয় জানা আছে আপনার।’ গুছিয়ে বলতে কিছুটা সময় লেগেছিল নবীর। ‘আমরা বাংলাদেশকে তাদের মাটিতে হারিয়েছি, এবার তাদের সিনিয়র ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া দলটিকেও হারাতে চাই। সেই সামর্থ্য আর সক্ষমতা আছে আমাদের।’

যে চেয়ারটিতে বসে কিছুক্ষণ আগে মাশরাফি বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানকে সম্মান করি আমরা।’ সেই চেয়ারে বসেই নবী বললেন, ‘এটা আমাদের প্রথম বিশ্বকাপ, আর প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচ পড়াটা আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।’ আসলে ম্যাচের আগে মনস্তাত্তি্বক একটি লড়াই যে শুরু হয়ে গেছে, তা এদিন মানুকা ওভালে উপস্থিত থাকা সবাই বুঝতে পেরেছেন।

তবে ‘আফগান’ নিয়ে এই চর্বিত চর্বণ মোটেই পছন্দ নয় মাশরাফিদের। তারচেয়ে বরং মানুকা ওভালের পিচ আর বাউন্ডারি সীমানা নিয়ে আলোচনায় বেশি আগ্রহী মুশফিকরা। যেমনটি করে থাকেন সবসময়, এদিন তেমনই অনুশীলন শেষে সেন্টার উইকেটের সামনে গিয়ে বসে পড়েছিলেন মুশফিক। ব্যাটিং শ্যাডোও করলেন কিছুক্ষণ। কাছেই ছিলেন আইসিসির প্রধান নির্বাহী ডেভিড রিচার্ডসন। এগিয়ে এসে তিনিও কাঁধে হাত রাখলেন মুশফিকের। কিছুক্ষণ কথাও বললেন মুশফিক-নাসিরদের সঙ্গে। বোধহয় বলছিলেন তাদের কাছে আইসিসির প্রত্যাশার কথা। ১৬ কোটির সমর্থকদের জন্য হলেও যে বাংলাদেশ দলকে বিশ্বকাপে ভালো খেলতে হবে, সেটা এদিনও বললেন তিনি এক বাংলাদেশি সাংবাদিককে।তা ছাড়া আয়ারল্যান্ড দু’দিন আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর বাংলাদেশের কাছে ক্রিকেটের এই সর্বোচ্চ সংস্থাটির চাওয়া বেড়ে গেছে। শোনা যায়, ম্যাচে যাতে বেশি রান হয় সে জন্য কিউরেটরকেও নির্দেশিকা দিয়ে গেছেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই তিন শতাধিক রান হচ্ছে। মানুকা ওভালেই বা আজ তার ব্যতিক্রম হবে কেন। ৩০০ রান করার মতো পাওয়ার মাসল নিয়ে তাই গতকাল বেশ কিছুক্ষণ নেটে কাটালেন হাথুরুসিংহে। তামিম ইকবালকে কাছে কাছে রাখলেন অনেকক্ষণ। কারণ তামিমের একটি বিস্ফোরক ইনিংসই বদলে দিতে পারে গোটা দলকে। মাঝেরটা সাকিব-মুশফিক আর শেষে এসে রুম্মান আর নাসির, মোটামুটি এ-ই হলো বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের আজকের রেসিপি। কিন্তু নির্দিষ্ট একাদশ কী? সেটা রণকৌশলের কারণেই গতকাল ফাঁস করতে চাননি মাশরাফি। তবে কান পেতে পাওয়া খবর হলো, আজকের একাদশে দেখা নাও যেতে পারে এনামুল হক বিজয়কে। তার বদলে বরং সৌম্য সরকারকে তামিমের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হতে পারে। সৌম্যের মতো সাবি্বর, তাইজুল, তাসকিন, নাসিরের জন্যও প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ। নতুনদের নার্ভ শক্ত রাখতে কি যথেষ্ট প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়েছে? ‘আমি বিশ্বাস করি, যে কোনো সাফল্যের পেছনেই নতুনদের বড় ভূমিকা থাকে। তা কেবল ক্রিকেটেই নয়, ক্রিকেটের বাইরেও ফ্রেশ ব্লাডরাই সাফল্য এনে দেয়। মনে আছে আমাদের ২০০৭ বিশ্বকাপের কথা। সেদিন তামিম, মুশফিক, সাকিবের প্রথম বিশ্বকাপ ছিল। এবার ওদের চেয়েও নতুনরা ভালো করবে বলে আশা করছি। আর আফগানিস্তানকে নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। এ রকম কিন্তু টি২০ বিশ্বকাপের আগেও বলা হয়েছিল। আমার মনে হয়, আফগানিস্তান সম্পর্কে দলের প্রতিটি ক্রিকেটার বেশ সচেতন। তারা জানে কীভাবে কোন কৌশল ব্যবহার করে ওদের হারানো যায়।’ কী সেই কৌশল? খুব বেশি গভীরে না গিয়েই উত্তরটি জানতে তাড়াহুড়া করছিলেন এক সাংবাদিক। মুচকি হেসে মাশরাফির উত্তর_ ‘এখানে এতগুলো মানুষের সামনে কি কৌশল বলা যায়। অপেক্ষা করুন দেখতে পাবেন আর কয়েক ঘণ্টা পর…।’এই অপেক্ষায় নিশ্চয় বিরক্ত ঝরবে না, যদি তা ‘শুভ’ কিছু হয়।

২ thoughts on “টাইগারদের জন্য শুভ কামনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.