সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারকারীদের তালিকা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

এইচএসবিসির ঢাকা অফিসের মাধ্যমে একই ব্যাংকের সুইজারল্যান্ড শাখায় টাকা পাচারকারীদের তালিকা চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (এফআইইউ) থেকে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়েছে।

এইচএসবিসির ঢাকা অফিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ১৭টি হিসাবে ১৬ জন গ্রাহক ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় ১০১ কোটি টাকা সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওই চিঠি দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও এফআইইউর উপ-প্রধান ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে এইচএসবিসির মাধ্যমে কারা টাকা পাচার করেছে সে বিষয়ে জানতে আমরা ইতিমধ্যেই সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছি। মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন ঠেকানোর লক্ষ্যে অনেক দেশই এখন পাচার করা টাকা সম্পর্কে তথ্য দিচ্ছে। আমরা আশা করছি সুইস ব্যাংকও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে সুইস ব্যাংক থেকে তথ্য পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ টাকা পাঠিয়ে থাকে তবে সেটি অবশ্যই অপরাধ। তবে কোনো বাংলাদেশী নাগরিক যদি বিদেশ থেকে তার উপার্জিত অর্থের কোনো অংশ পাঠিয়ে থাকে তাহলে তা কোনো অপরাধ নয়।
এইচএসবিসি : ৯ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক কনসোর্টিয়াম (আইসিআইজে) হংকংয়ে নিবন্ধিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক দি হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (এইচএসবিসি) মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার করা টাকার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। ২০৩টি দেশের গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেশভিত্তিক ওই তালিকা প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৮ নম্বরে। তাদের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ১৭টি হিসাবের মাধ্যমে ১৬ জন গ্রাহক ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার করেছে। ওইসব অর্থ বাংলাদেশের এইচএসবিসির শাখা থেকে সুইজারল্যান্ডের শাখায় বেআইনিভাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়েছে গ্রাহকদের ১০টি ব্যক্তিগত এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ৭টি হিসাব। ব্যক্তিগত ১০টি হিসাবের মধ্যে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী রয়েছেন ৫ জন। তবে এদের পরিচয় সম্পর্কে সংস্থাটি কিছুই প্রকাশ করেনি।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সুইস ব্যাংকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, এইচএসবিসির ঢাকা অফিস থেকে একই ব্যাংকের সুইজারল্যান্ড শাখায় টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রচলিত আইনে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাঠাতে হলে আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এই ধরনের কোনো অনুমোদন দেয়া হয়নি। ফলে বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ টাকা পাঠিয়ে থাকে তা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ। এ ধরনের অপরাধ দমনে সুইস ব্যাংকের সহায়তা কামনা করে বাংলাদেশ থেকে কারা কিভাবে টাকা পাঠিয়েছে সে সম্পর্কে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের শেষের দিকে এইচএসবিসির সুইস শাখার সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী হার্ভে ফালসিয়ানি এক লাখের বেশি গ্রাহকের তথ্য চুরি করে ফ্রান্সে পালিয়ে যান। মূলত ওই তথ্যের ভিত্তিতেই যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান, ফরাসি পত্রিকা লা মঁদ, বিবিসি প্যানোরামা ও ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করে।
এ ঘটনায় রোববার যুক্তরাজ্যে এইচএসবিসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে গ্রাহকদের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়েছে।
সাড়া মেলেনি সুইস ব্যাংকের : গত বছরের জুনে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাদের দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তির আমানত বেড়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ কোটি ২০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্রাঁ ৯০ টাকা হিসাবে)। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ১ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।
এ ঘটনা প্রকাশিত হলে গত বছরের ২৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে চিঠি দেয়। এতে ওই দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের যেসব ব্যক্তি আমানত হিসেবে টাকা জমা রেখেছেন তাদের তালিকা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৮ মাস অতিবাহিত হলেও ওই চিঠির ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
গত বছরের জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার বিষয়ে আরও একটি চিঠি দেয়া হয়। আর্থিক অপরাধের বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য দুপক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্মারক থাকলে এটি করা সহজ হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত ১৭টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সুইজ ব্যাংক এখন পর্যন্ত কোনো আগ্রহ দেখায়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানতের তথ্য জানতে চেয়ে দেয়া চিঠির ব্যাপারে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি সাড়া মিলবে। কারণ এ ক্ষেত্রে আইনগত প্রক্রিয়ার কিছু ব্যাপার রয়েছে।
তথ্য পাওয়া দুষ্কর : বিশ্বব্যাপী মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করছে এগমন্ট গ্রুপ। বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের ১৪৭টি দেশ এর সদস্য। এগমন্ট গ্রুপের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ড থেকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তির নাম ঠিকানা দিয়ে তথ্য চাইতে হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে টাকা পাচারকারীদের কোনো নাম-ঠিকানা নেই। ফলে এগমন্ট গ্র“পের মাধ্যমে তথ্য চাওয়ার সুযোগ নেই।
দ্বিপক্ষীয়ভাবেও সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা দিয়ে পাচারকারীদের সম্পর্কে তথ্য চাইতে হবে। এটিও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কারা টাকা পাচার করেছে তাদের তালিকা চেয়েছে। কোনো নাম-ঠিকানা দিতে পারেনি। ফলে এভাবে চাওয়া তথ্য না দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশী কোন নাগরিকদের তাদের দেশে টাকা রয়েছে সে তালিকা দেবে কি না তা আমরা জানি না। তবে চাইতে তো সমস্যা নেই।

আতিক/প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.