চলমান আন্দোলনের স্টিয়ারিং এখন তৃণমূল নেতাকর্মীদের হাতে

মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনের চালকের আসনে এখন তৃণমূল। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের কয়েক দফার সফলতাও মিলেছে আন্দোলনকারীদের চোখে। তাদের হিসাব-নিকাশে সরকার পতনের আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয় আসন্ন। চলতি সপ্তাহে অর্জনের খাতায় আরো সাফল্য যোগ হওয়ার ইঙ্গিত পেয়েছে আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনের গতি পরিবর্তনের চাবি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শীর্ষ নেতাদের নাগালের বাইরে। এ বিশ্লেষণ রাজনৈতিক বোদ্ধামহলেরও। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নূরুল আমিন বেপারীর মতে, একটি দল ও জোটের আন্দোলন জনতায় ছড়িয়ে গেছে। নির্যাতনের ফলে নেতাকর্মী হারানোর শোক চলমান আন্দোলনের শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতে, শীর্ষ নেতাকে ‘বিচ্ছিন্ন’, সিনিয়র নেতাদের কারাবন্দি, কথায় কথায় হামলা-মামলা, গুম, খুন, দেখামাত্র গুলি-ক্রসফায়ার, ট্রাক-বাস চাপার ঝুঁকির মুখেও দীর্ঘ দেড় মাস রাজপথে টিকে থাকাই প্রথম সফলতা। এছাড়াও তাদের দাবির প্রতি দেশের সুশীল সমাজ ও বহির্বিশ্বের সমর্থন সফলতার আরেক দিক। সর্বোচ্চ প্রতিকূল পরিস্থিতি আসলেও সেটা মোকাবিলার ছক তৃণমূল নেতাদের হাতে আগেই দিয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্ব। নতুন করে দিকনির্দেশনার প্রয়োজন নেই বলে মনে করছেন আন্দোলনকারীরা।
এদিকে নেতাদের ভূমিকার খবর রাখছেন দলের শীর্ষনেতা বেগম খালেদা জিয়া ও দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান। ইতোমধ্যে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের বেশকিছু নেতাকে তাদের চলার দিক বদলের জন্য সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছে।
গত ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন ও বর্তমান সংসদকে অবৈধ আখ্যা দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। অংশগ্রহণমূলক, নির্দলীয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বছর জুড়ে গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ করেছে।
গত ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা’ দিবস পালনকে কেন্দ্র করে ৪২ দিন ধরে চলছে অবরোধ। সাথে ইস্যুভিত্তিক হরতাল। এরই মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনকে অবরুদ্ধ রাখার অভিযোগ উঠেছে। তার কার্যালয়ে অবস্থানরতদের খাবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গত ৬ দিন ধরে।
এদিকে কর্মসূচি চলাকালে সারা দেশে সহিংসতা, যানবাহনে আগুন, পেট্রোল বোমা, ক্রসফায়ার, ট্রাক-বাসচাপায় হত্যা, গ্রেফতারের পর গুলি, গুম-খুনের ঘটনায় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। বিরোধী নেতাদের বাসা-বাড়িতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। বিএনপিসহ শরিক দলের সিনিয়র নেতাদের বেশিরভাগই কারাবন্দি।
তবে এর প্রভাব পড়েনি কর্মসূচিতে। গত শনিবার ছিল বিক্ষোভ মিছিল। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও সে বাধা ডিঙ্গিয়ে রাজধানীর ২০টি পয়েন্টসহ দেশের ৪৪ জেলা শহরের রাজপথে নেমেছিল নেতাকর্মীরা। গত ৪২ দিনের মতো অবরোধ কর্মসূচিও অব্যাহত রেখেছে।
বিএনপির তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই সরকারদলীয়রা নাশকতা করছে। নাশকতার জন্য আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের প্রচার এখন অপপ্রচারে পরিণত হয়েছে। দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল বোমা ও ককটেল নিক্ষেপের সময় হাতেনাতে যারা ধারা পড়েছে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের। বোমা বিস্ফোরণ ও তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে তাদের দলীয় কার্যালয় থেকেই।
এদিকে বিরাজমান সঙ্কটক নিরসনে সরকারকে আন্দোলনকারীদের সাথে সমঝোতা-সংলাপে বসার জন্য তাগাদা দিয়েছে দেশের সুশীল, নাগরিক, ব্যবসায়িসহ পেশাজীবী প্রতিনিধিরা। সংকটের সমাধান না পেলে বিদ্যুৎ বিল দেবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সংলাপের তাগিদ দিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্ব মোড়লরা। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে দেশের বিপর্যস্ত মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখার জন্যও প্রতিনিধি প্রেরণ করেছে ইইউ। এ সবই সফলতা বলে ধরে নিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান জানান, বিএনপি মনে করছে চলমান আন্দোলন যেভাবে এগুচ্ছে তাতে মার্চের আগেই চলমান আন্দোলন একটি যৌক্তিক পরিণতি পাবে। তিনি বলেন, দ্রুত অবস্থার পরিবর্তনের নজির স্পষ্ট। ইতোমধ্যে সেই নজির দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সঙ্কট নিরসনে উদ্যোগী হয়েছেন। দেশের নাগরিক সমাজও এই অবস্থার অবসানে মাঠে নেমেছে।
বিএনপির এই নেতা জানান, খুব শিগগিরই আওয়ামী লীগ একঘরে হয়ে যাবে। গোর্য়াতুমির পরিণতি আওয়ামী লীগকেই পতনের দিকে নিয়ে যাবে।
বিএনপির বর্তমান মুখপাত্র সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ দাবি করেছেন, গত ৪০দিনে তিন শতাধিক নেতাকর্মী গুম, খুনের শিকার হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, সম্পাদকসহ কর্মী পর্যায়ের প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, চলমান আন্দোলনের স্টিয়ারিং এখন তৃণমূল নেতাকর্মীদের হাতে। কেন্দ্রীয় নেতাদের বন্দি করে সরকার তার গদি রক্ষার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হবে।
বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ঘরে বাইরে ফুটপাতে কোথাও অবস্থান করা যাচ্ছে না। যেখানে যাকে পাচ্ছে তাকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। পাইকারি হারে গ্রেফতার করে আন্দোলনকে দমন করার ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে এগুচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, আন্দোলনের করণীয় নিয়ে দলের চেয়ারপারসন তাদের আগাম দিকনির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। তাকে গ্রেফতার করা হলেও আন্দোলন বন্ধ হবে না। বরং নেতাকর্মীরা আরও বেশি চাঙ্গা হবেন। শুধু দলের চেয়ারপারসন নয়, লন্ডন থেকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। চূড়ান্ত সফলতা না আসা পর্যন্ত আন্দোলন থামার কোন আলামত নেই বলে দাবি করেন বিএনপির এই নেতা।

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম মহানগর নেতা মাহবুবুর রহমান শামীম বলেন, কীভাবে আন্দোলনকে আরও গতিশীল করা যায় সে ব্যাপারে নানা দিক নির্দেশনাও ইতোমধ্যে তারা পেয়েছেন। দলের চেয়ারপারসনের পক্ষ থেকে কয়েকদিন আগে টেলিফোনে তাদের বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনায় নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়েছে। চেয়ারপারসনকে গ্রেফতার করা হলে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বগুড়া বিএনপির সভাপতি ভিপি সাইফুল ইসলাম বলেন, আন্দোলন এখন তৃণমূলের হাতে। সরকার এখন ঢাকায় বন্দি। ঢাকার নেতারা ব্যর্থ হলে প্রয়োজনে জেলার নেতাকর্মীরা ঢাকায় যেতে প্রস্তুত আছে।
মেহেরপুর জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি মাসুদ অরুণ বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতার করে দমনপীড়ন করে সরকার শেষ রক্ষা পাবে না। তারা যেমন অক্সিজেন বন্ধ করে দেয়ার হুঙ্কার দিয়েছিল। আমরাও এবার সরকারের এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের ঘরছাড়া করতে প্রস্তুত। এ নির্দেশনা কেন্দ্র থেকে দিতে হবে না। পরিবেশই বলে দেবে কখন কি কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।
সিলেট মহানগর বিএনপি নেতা মুক্তিযোদ্ধা সালেহ আহম্মেদ বলেন, গুম-খুন, ক্রসফায়ার দিয়ে ১৬ কোটি মানুষ শেষ করতে চাইলে সে সংখ্যায় তো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও পড়ে। জনরোষে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে গ্রাম পর্যায়ে তাদের নেতাকর্মীদের গণধোলাই শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নূরুল আমিন বেপারীর মতে, সরকারবিরোধী আন্দোলন একটি দল ও জোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এ আন্দোলন দেশের সকল মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। এছাড়াও গুম, খুন, ক্রসফায়ারসহ নানা নির্যাতনের ফলে নেতাকর্মী হারানোর শোক চলমান আন্দোলনের শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর আন্দোলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বেশকিছু নেতাসহ বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেটের বেশ কিছু নেতার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব তারেক রহমান। ইতোমধ্যে তারবার্তায় তাদের সকর্ত বার্তা দেয়া হয়েছে।

আতিক/প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *