“সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো নিয়ে আরেকবার ভাবুন সবাই”

আমি দীর্ঘ ৫ বছর সৌদি আরবে ছিলাম। আমার নিজের চোখে দেখা নারী শ্রমিকদের কষ্টের কথা লিখছি।ভয়াবহ সব দিন কাটানো মানুষগুলোর অনেক গল্পের কয়েকটা গল্প তুলে দিলাম। এটা খুব সামান্য এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পরতে হয় ওদের কে। আমি নারী শ্রমিক রপ্তানীর বিরোধী নয়। তবে সে ক্ষেত্রে দক্ষ, শিক্ষিত ও ভাষা জ্ঞান সম্পন্ন নারী শ্রমিক পাঠানোর দাবী করি। যারা নিজেদের অধিকার চাহিদা নিয়ে সচেতন। আরবরা ব্যাক্তিগত ভাবে কাজের লোক বা খাদ্দামাদের প্রতি নির্দয়। সদয় পাওয়াও যায় তবে সেটা লাখে একটা। এ ক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে আমরা কি আমাদের বোনদের একটি হাইলি একোমডেট কারাগারে পাঠাবো যেখানে সে নিপীড়িত হবে।
দৃশ্য-১
১৭/৪/২০০৬
ভোর -৬টা

স্থান: গুলশান সৌদি দূতাবাস এর প্রধান ফটকের বাইরে।
সবাই লাইনে দাড়ানো। একজন মহিলা একটা দুধের শিশু কোলে নিয়ে দাড়িয়েছেন, বাচ্চাটা কাদছে অবিরত। একেতো ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে লাইনে এর পরে সামনে একটা বাচ্চার আবিরাম কান্না। মেজাজ খারাপ হলেও করতে পারছিনা মহিলার দারিদ্রমাখা মলিন চেহারা দেখে। অবাক হলাম আপনি এখানে কেন দাড়িয়েছেন এইটা তো ভিসার লাইন। উত্তর দিলেন ভিসার জন্য। কি????????????/ মাথা ঘুরে যাওার দশা। ঘুম পুরা উধাও। কি করবেন সউদি গিয়ে? খাদ্দামার কামে যাইমু। খাদ্দামা শব্দটার সাথে পরিচয় ছিলো না কিনতু বোঝার চেষ্টা করলাম, বুঝলাম কাজের লোক। কিন্তু আপনি কি কাজ করবেন? যে কাম দেয় হেইডা করমু। বিস্ময়ের চুড়ান্ত। আরবী বলতে পারেন? না পারি না। কিভাবে কথা বলবেন? হিগগা ফালামু। বাংলা বা ইংরেজী লিখতে পড়তে পারেন? না পড়া লিখা জানি না। কেনো যাচ্ছেন? বইন বড় অভাব গেনদার বাপের কোনো কাম নাই। স্বামীকে দেখালেন। লাইনের বাইরে পার্কের গেটের সামনে বিড়ি ফুকছেন। ভাদাইম্যা শব্দটা তার জন্য যথাযথ। বললাম কিভাবে ভিসা পেলেন? আমার দুলাভাই যোগাড় করছে। কত টাকা লাগছে? ৩লাখ টেকা। টাকা কে দিল? আমার মায়ের যা আছিল বেইচা দিছে। যে বাড়িতে কাজ করবেন ওরা কত টাকা দিবে? জানি না, দুলাভাই জানে। হেরেও টেকা দিতে হইবো। হে ভিসা কিনছে ৪০হাজার টাকা দিয়ে।
তখন ও সেই মহিলার প্রবাস জীবনের ভয়াভতা আচ করতে পারি নাই। তবে সন্দিহান ছিলাম আদৌ তার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে কিনা।
দৃশ্য-২
১৮/০৭/০৬
স্থান : আমার ক্লাশরুম
সকাল-৮টা

আমাদের স্কুলের আয়া এসে বলল আপা ২টা কাম কইরা দিবেন? বললাম কি? একটা ক্যামেরা আর একটা মোবাইল কিননা দিবেন ফোডো তুলন যায় এমন মোবাইল। বাজেট কত? আপা ৬০০রিয়াল। ওকে, কি জন্য কিনবেন? আপা আমার পোলাডার লাইগগা কিনমু। পাঠাবেন কি করে? আপারা বাড়ি যাইতেছে ওদের কাছে দিমু। আপার বাসা থেইককা আমার পোলা লইয়া যাব। গুড, ২য় কাজটা কি। আপা একটা চিঠি লিখা দিবেন? মোবাইলে মেলা পয়সা কাটে। ওকে করে দিব।
আপাতত নাটকের বিরতি। আসেন আমাদের আয়ার ফ্লাশবেক এ যাই।
মোটামুটি সম্ভ্রান্ত ঘরের এতিম মেয়ে। অনেক কস্ট করে বড় হয়েছে। বিয়ের পর ২সন্তান রেখে স্বামী মারা যায়। অভাবের তারনায় আর প্রতারকের খপ্পরে পরে সউদি আরব আসা। যাদের আন্ডারে ভিসা নিয়ে এসেছিলেন তাদের চুড়ান্ত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশ কনসুলেটে। ছেলেদের ব্যাপারে যতটা নির্দয় হননা কেন মহিলাদের প্রতি আমাদের কর্মকর্তাদের একটা ভালোবাসা আছে। এক কারণ উনাদের বৌদের সোনার বরন কালো হয়ে যাচ্ছে কাজের লোকের অভাবে। সুতরাং বাংলাদেশি একটা কাজের মহিলা হাত ছাড়া করা যায় না। তাদেরকে রাখা হয় কনসুলেটের বিভিন্ন কর্মচারির বাসায়। মোটামুটি নিরাপদ একটা আবাস। এটা তাদের ই কপালে জোটে যারা পালিয়ে আসতে পারেন। আর যারা পারেন না তাদের কথা ধারাবাহিক ভাবে বলছি।
দৃশ্য-৩
তারিখ মনে নাই
স্থান : আমার বাসা
বিকাল

মোটামুটি সেচ্চাসেবক হিসাবে একটা সুনাম আছে। তার সুবাদে একজন সিনিয়র কলিগ ফোন করে বললেন একটু উপকার করবা? আমি বললাম কি আপা বলেন। আমার বুয়াটাকে তোমার বাসায় পাঠাচ্ছি একটু কি কোনো মহিলা ড: এর কাছে নিয়ে যাবা। প্রথমেই প্রশ্ন করলাম আপনি বুআ কোথায় পেলেন? বললেন কনসুলেটের এক ভাই যোগাড় করে দিয়েছেন। কিন্তু খুব অসুস্থ। আমি বললাম পাঠিয়ে দিন। যে মহিলাটা আসলেন খুব বিধ্বস্ত চেহারার একজন মানুষ বয়স আনুমানিক ৩৫। যেতে যেতে অনেক কথা হল। কি করে আসলেন কি করেন। পুরানো ঘটনা দালাল নিয়ে এসেছে। ভাষা জানেন না বলে কাজ করতে পারতেন না। মুনিব অত্যাচার করত। সারাদিন ঘরে বন্দি কারোর সাথে যোগাযোগ করতে পারতেন না। ওদের যে খাবার গুলো দিত সেগুলো খেতে পারতেন না।
সবচেয়ে বড় যে কষ্ট পেয়েছেন সেটার বেপারে উনি কিছু না বললেও ডঃ জানালেন। পরিক্ষা নিরীক্ষা শেষে বললেন। যে রোগ একটা সময় পর্যন্ত ভালো থাকবেন চিকিৎসা পেয়ে। কিন্তু জের টানতে হবে সারাজীবন। কিছুটা আঁচ করতে পারলেও প্রশ্ন করলাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য। রোগ টা কি? উত্তরে যা জানলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। উনি যৌন হয়রানির শিকার। একবার না অনেকবার ধর্ষিত হয়েছেন, একজন না অনেকজন দ্বারা। পা থেকে মাথা কেপে উঠল। এখন হয়তো কিছুদিন ভালো থাকবেন কিন্তু ভবিষ্যতে এটি গনরিয়া নামক ভয়াবহ যৌন রোগে পরিণত হবে আপাত দ্‌ষ্টে লক্ষণ তাই বলে। ভাষা হারিয়ে ফেললাম। প্রয়োজন মাফিক ঔষধ কিনে দিলাম। বললাম, “কেন আসছিলেন এখানে?” ….”বইন ভাবছিলাম সুখে থাকমু কাম করমু পোলার বাপের টেকা পাঠামু জমি জিরাত করমু।”…. “টাকা পাঠাতে পেরেছেন?” ….”নাগো বইন পালাইয়া আসাতে কাগজ ও রাইখা আইসা পড়ছি যামু কই কি করমু কিছুই জানি না। যদি আপাগো বাড়িতে কাম কইরা কিছু টেকা জমাইতে পারি ধার দেনা শোধ দিয়া বাড়ি যামুগা। এইখানে থাকুম না।”
খুব মায়া লাগল কিন্তু কিছুই করতে পারছিনা। একবার প্রশ্ন করতে চাইলাম কি অসুখ জানেন কি? করলাম না। ঘরে ফিরে যাবার আশা ভংগ করতে মন চাইলো না। স্বপ্ন তো আমরা সবাই দেখি। কারো স্বপ্ন ভাংগার অধিকার নাইবা নিলাম। ধার শোধ করে বাড়ি ফিরে যাবেন। সংগে এই দেশের কদর্যতা নিয়ে যাবেন। আর তাদের টাকা দিয়েই আমাদের রেমিটেন্স বাড়বে। আমরা গর্ব করে বলব আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। জানবো ও না এর মধ্যে এমন সব মানুষের পাঠানো টাকা আছে জীবন যাদের কাছে বিভাষিকাময়। এর পর এরা যখন দেশে ফিরে আসবে বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তারা তাদের মাল রেখে দিবেন। সব হারিয়ে কাঁদবেন অসহা্য় একজন মহিলা। এমন ছবি সহ খবর ছাপিয়ে বাহবা কুড়াব।
দৃশ্য-৪
তারিখ : মনে নাই
স্থান : আমার বাসা

আমি হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি। একলা মানুষ খাবার দাবার রান্না করা খুব কস্টের ঘরের কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ায় সকলের পরামর্শ মোতাবেক একজন কাজের লোক রাখি। এমন ই একজন পালিয়ে আসা বাংলাদেশী মহিলা। বয়স আনুমানিক ৩৩ হবে। আমার কাজের ব্যাপারে খুব খুতখুতানি আছে। নিজের কাজ নিজেই করি। তাই বুয়াকে আদ্যপান্ত দেখার সময় দেখলাম হাত ভরা ইনফেকশন। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? বলল, আপা জানি না চুলকাতে চুলকাতে হয়েছে। এখানকার আবহাওয়া এত শুস্ক যে এই ধরনের খুজলী পাচড়া টাইপের রোগ নেই। বললাম, আর কারো দেখেছেন? এরকম হয়েছে? বলল যে সউদি বাড়িতে কাম করতাম হেই বাড়ির একজনের ছিল। কার প্রশ্ন করায় উত্তরে অনিহা দেখে আমি আর প্রশ্ন করলাম না। আমি বললাম ঠিক আছে আমি রাতে ডঃ এর কাছে যাব আপনাকে নিয়ে যাব।
যথারিতী একি ঘটনা অভাব মোচনে এ পথে পা বাড়িয়েছেন। বাড়িতে টাকা পাঠানোই একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই করে চলছেন ৪বছর ধরে। বেশ কিছুদিন হল পালিয়ে এসেছেন। কারণ অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন আর পারছেন না তাই এই পালানো। মাঝখানে একবার মালিকএর বউ মেরে মাথা ফাটিয়েও দিয়েছিলেন। ঋন মোটামুটি শেষ । আমি বললাম তো বাড়ি ফিরে যাচছেন না কেন? যেটা বলল সেটা আরো বেদনার। গেনদার বাপের আমার পাঠানি টেকা দিয়া বাড়ি তুলছে পোলা আর মাইয়ারে বাড়ি থেইকা বের করে দিছে। হে নয়া বিয়া করছে। মানুষ নাকি তাকে বুঝিয়েছে তোমার বউ আর ভালো নাই। বইন দেশে গেলে আর কি করমু। পোলাগো কি খাওয়ামু। তাই মেলা কস্ট কইরা থাকতেছি। পোলারা আমার ভাইয়ের কাছে টেকা তারেই পাঠাই। ওরা মানুষ হইলে আমি বাড়িত ফিরা যামু। রাতে ডঃ এর কাছে নিয়ে গেলাম । আমি মোটামুটি প্রস্তুত ছিলাম কি রোগ জানার জন্য । আবার পুনারাব্‌ত্তি । বহু মানুষ দাড়া যৌন নির্যাতনের শিকার। যার কারনে শরীরে নানাবিধ রোগ বাসা বেধেছে। নারী হিসাবে লজ্জা পেলাম। কি লাভ এত ত্যাগের। কেও কি এর মুল্য দিবে। দেশে ফিরে গেলে তাকে মানুষ নষ্টা বলে অপবাদ দিবে। এক ঘরে করে রাখবে। আর বেশি কিছু কি আশা করতে পারি?

লিখেছেন- ফাতেমা আবেদিন নাজলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *