ঘরে প্রসববেদনায় কাতরানো স্ত্রীকে সহায়তার জন্য ধাত্রী খুঁজতে বেরিয়েছিলেন যুবদল নেতা আরিফুল হাসান। প্রথম ‘বাবা’ হওয়ার রোমাঞ্চ তার দেহমনে। আর হয়তো কয়েক ঘণ্টা পরই দেখতে পাবেন তার চির আকাক্সিক্ষত সন্তানের মুখ। কিন্তু হল না। বাবা ও তার অনাগত সন্তানের মাঝে দাঁড়িয়ে গেল বুলেটের এক দেয়াল! পুলিশের বুলেট কেড়ে নিল আরিফুলকে। আর স্ত্রী রাশেদা বেগম এক পুত্র সন্তানের আগমনের বিনিময়ে হারালেন তার প্রিয় তরুণ স্বামীটিকে। শনিবার রাতে উপজেলার নুনাছরা এলাকার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিতে আরিফ নিহত হওয়ার ৭ ঘণ্টা পর জন্ম হয় তার ছেলের। এই মর্মান্তিক মৃত্যু এবং জন্মের খবর ঘিরে এখন উপজেলার সর্বত্র শোকের ছায়া।
অবশ্য মৃত্যু নিয়ে পুলিশ যথারীতি দাবি করেছে, নাশকতাকালে আরিফুল হাসান ও তার সহযোগীদের হাতেনাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার আগে আরিফুল ও তার সহযোগীরা গুলি করেন। আর সেই কথিত গুলির কবল থেকে নিজেদের জীবন ‘বাঁচাতে’ পুলিশ গুলি ছোঁড়ে এবং তাতেই মারা যান আরিফ।
তবে নিহতের মা হাসান বানু পুলিশের এ বক্তব্যকে বানানো গল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলছেন, সন্ধ্যার পর থেকে তার পুত্রবধূ প্রসব বেদনায় ছটফট করছিল। ধাত্রীর খোঁজে আরিফ ছুটে যায় সীতাকু- সদরে। তবে ওই ধাত্রীকে পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে প্রতিবেশী এক ধাত্রী এসে হাজির হন বাড়িতে। মোবাইল ফোনে এ খবর দেয়ার পর অটোরিকশাযোগে সীতাকু- সদর থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরছিল সে। কিন্তু তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি। গভীর রাতে খবর আসে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে আরিফ।
আরিফের প্রতিবেশীরাও বলছেন, তাকে হত্যা করা হয়েছে। স্ত্রীর প্রসব বেদনা চলাকালে কোন মানুষ রাস্তায় বোমাবাজি কিংবা পুলিশের ওপর হামলা করতে যেতে পারে এটা বিশ্বাস করতে পারছে না কেউ। প্রসব বেদনায় স্ত্রী যখন ছটফট করছিল তখনই বাড়িতে আরিফের মৃত্যুর সংবাদ আসে। আতঙ্ক আর বেদনায় মুষড়ে পড়েন স্ত্রী। গতকাল রোববার সকালে তার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে পুত্র সন্তান। দুনিয়ার আলো দেখার আগেই এতিম হয়ে গেল এ শিশুটি। আরিফের এ মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ। নিহত আরিফ উপজেলার বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক এবং ঐ এলাকার পশ্চিম লালানগর গ্রামের মো. জয়নাল আবেদীনের পুত্র। আরিফের সাথে পুলিশের গুলিতে আরও যারা আহত হয়েছেন তারা হলেন আবুল বশরের পুত্র মো. পারভেজ (১৮), নাদেরুজ্জামানের পুত্র মো. রুবেল (১৬), জহির আহমেদের পুত্র মো. সোহেল (১৬), নূরবক্সের পুত্র নুরুল হাদী (২০)। তাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এদের মধ্যে ২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের সবাইকে দুই পায়ের হাঁটুর নিচে এবং উরুতে একাধিক গুলি করা হয়েছে। অপরদিকে এ ঘটনায় পুলিশ পৃথক ৩টি মামলা দায়ের করেছে। প্রত্যেক মামলায় সুনির্দিষ্ট ২০ জনকে আসামি করা হয়।
থানা সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার রাত আনুমানিক ৯টায় উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নুনাছরা এলাকায় পুলিশের গুলিতে ৫ যুবদল-ছাত্রদল নেতা গুরুতর জখম হয়। পরে তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে যুবদল নেতা আরিফ হোসেন মারা যায়। সীতাকু- থানার ওসি মো. ইফতেখার হাসান এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, ঘটনার সময় যুবদল-ছাত্রদল ও জামায়াত-শিবিরকর্মী যানবাহনে নাশকতার চেষ্টা করছিল। এসময় পুলিশের একটি টহল টিম সেখানে উপস্থিত হলে দুষ্কৃতকারীরা তাদের ওপর হামলা চালাতে এগিয়ে আসে। এতে নিজেদের বাঁচাতে পুলিশ গুলি চালালে তারা পালিয়ে যায়। পরে আশপাশে তল্লাশি চালানো হলে শিম ক্ষেতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৫ ছাত্রদল-যুবদল কর্মীকে দেখে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ১টি এলজি, ১০টি ককটেল ও ২টি পেট্রোল বোমা ও কার্তুজ উদ্ধার হয় বলেও পুলিশের দাবি।
ওসি বলেন, আহতদের সীতাকু- হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় আরিফ হোসেন মারা যান। অন্যদিকে আহতদের বরাত দিয়ে তাদের স্বজনরা বলছেন, আরিফ অটোরিকশাযোগে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় অটোরিকশাটি ওই এলাকায় পৌঁছলে মহাসড়কে টহল পুলিশ অটোরিকশাটি থামার জন্য সিগন্যাল দেয়। কিন্তু চালক সিগন্যাল বুঝতে না পেরে সামনে এগিয়ে গেলে পুলিশ অটোরিকশাটি আটক করে। এরপর তাদের ৫ জনকে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। আহতদের স্বজনরা জানান, গুলি করার আগে পুলিশ তাদের কোন কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। গতকাল আরিফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে শোকের মাতম চলছে। তার বৃদ্ধা মা ও স্ত্রীর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের বাতাস। আরিফের মা হাসান বানু সাংবাদিকদের বলেন, শনিবার ঘটনার কিছুক্ষণ আগে আরিফের স্ত্রী রাশেদা বেগমের প্রসব বেদনা ওঠে। আরিফের এক ফুফু ধাত্রী হিসেবে পারদর্শী হওয়ায় রাত ৮টার দিকে সে ঐ ফুফুকে আনতে সীতাকু- সদরে যান। কিন্তু ততক্ষণে একই বিষয়ে পারদর্শী তার এক চাচি বাড়িতে এসে পৌঁছলে আরিফকে মোবাইলে বাড়ি ফিরে আসতে বলা হয়। সে যখন বাড়ির দিকে ফিরছিল তখন পুলিশ আরিফকে ধরে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করে হত্যা করে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
সীতাকু- থানার ওসি মো. ইফতেখার হাসান অবশ্য হত্যার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ছেলেটি মারা যাওয়ায় তার পরিবার এমন দাবি করছে। আরিফের বিরুদ্ধে দুটি মামলা আছে। পুলিশ কোন নিরীহ লোককে হত্যা করে না বলে মন্তব্য করেন ওসি। এদিকে আরিফের মৃত্যু অন্যদিকে অল্প সময়ের ব্যবধানে তার সন্তানের জন্মের এ কাহিনী এলাকায় প্রচারের পর সর্বত্র আলোচনার বিষয় ছিল এ ঘটনা। বিশেষত সদ্যজাত সন্তানকে আরিফের দেখা হলো না বলে আফসোস করেন অনেকে। অন্যদিকে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে সীতাকু- উপজেলা বিএনপি। থানা বিএনপির আহ্বায়ক তোফাজ্জেল হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক জহরুল আলমসহ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তারা দাবি করেন, পুলিশ পরিকল্পিতভাবে যুবদল নেতা আরিফসহ ৫ জনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করে। তারা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।
আতিক /প্রবাস