রুহুল আমিন। ৩০ কিংবা ৩২ বছরের যুবক। হাতে একটি বড় ব্যাগ। বিমানবন্দরের প্রবেশ পথের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তিনি বার বার চোখের পানি মুচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন বোরকা পরা এক মহিলা। মহিলার সঙ্গে থাকা ২টি শিশু চিৎকার করে কাঁদছে। এ দৃশ্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশ পথের। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টার দিকে এ দৃশ্য চোখে পড়ে। জানতে চাইলে রুহুল আমিন বলেন, ‘বড় ভাই সউদী আরব যাচ্ছেন। তাকে বিমানবন্দর পৌঁছে দিতে এসেছি। সঙ্গে ভাইয়ের স্ত্রী ও ২ শিশু সন্তান। কিন্তু পুলিশ আমাদের ভেতরে যেতে দেয়নি। গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে। যাত্রী ছাড়া নাকি কাউকে যেতে দেবে না। পরে বাধ্য হয়ে প্রবেশ পথেই বড় ভাইকে বিদায় জানাতে হলো।” তিনি আরো বলেন, বিমানবন্দরের সামনের প্রধান সড়কের গোলচত্ব¡র পেড়িয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার পথেই গাড়ি থামিয়ে দেয় পুলিশ। গাড়ি তল্লাশির সময় দুই দিক থেকে ঘিরে অস্ত্র হাতে তাঁক করে রাখে পুলিশ। পুলিশের মারমুখী অবস্থা দেখে শিশুরা ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। রুহুল আমিনের অভিযোগ শিশুরা এতটাই ভয় পেয়েছে তারা চোখ খুলে তাকাতেও সাহস পাচ্ছে না। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অবস্থা দেখে মনে হয় না এটা কোন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। মনে হয় যেন যুদ্ধের ময়দান। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হবিগঞ্জ থেকে আসা সালেহা বেগম, কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর থেকে আসা রোকেয়া বেগম ও তার বাবা সেলিম হোসেন। তারা সবাই আপনজনকে বিদায় দিতে এসে বিমানবন্দরে দুর্ভোগের শিকার হন।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমর্ড ব্যাটেলিয়ন পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, নাশকতার আশঙ্কায় বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যই চেক পোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। সিভিল অ্যাভিয়েশনের জনসংযোগ থেকে জানানো হয়, সরকারের নির্দেশে ১৩ জানুয়ারি থেকে যাত্রী ছাড়া সকলের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সিভিল অ্যাভিয়েশনের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নাশকতা রোধে সরকারের নির্দেশে বিমানবন্দরে সবধরনের দর্শনার্থী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে অস্ত্র উঁচিয়ে যাত্রীদের গাড়ি থামিয়ে চারদিক ঘিরে অস্ত্র তাঁক করে রাখার বিষয়টি জানতে চাইলে সিভিল অ্যাভিয়েশনের কর্মকর্তাদের কেউ কোন ধরনের মন্তব্য করতে চাননি। প্রঙ্গত, প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার নামে অস্ত্র প্রদর্শনের নজির বিদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেই বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিরাপত্তার নামে চলছে হয়রানি। যাত্রীর সাথে আসা পরিবারের সদস্যদের বিমানবন্দরের প্রবেশ পথেই আটকে দেয়া হচ্ছে। গাড়ি থেকে টেনে হিঁচরে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে যারা বিদেশ থেকে আসছেন বা যারা যাচ্ছেন শুধু তারাই নন তাদের পরিবারের সদস্যরাও বিপাকে পড়ছেন। তারা বলেন, ২শ’ টাকার টিকিট কিনে বিমানবন্দরের কনকোর্স হল এলাকায় দর্শনার্থী ও যাত্রীদের স্বজনেরা প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু গত এক মাস ধরে তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোন অবস্থাতেই যাত্রী ছাড়া কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। দর্শনার্থীদের প্রবেশ টিকিট বিক্রি বন্ধ রয়েছে গত এক মাস ধরে। যাত্রীর সাথে আসা স্বজনদের পোহাতে হচ্ছে নানা দুর্ভোগ। স্বামী কিংবা সন্তানকে বিদায় জানাতে এসে কিংবা বিদেশ ফেরত আপনজনদের রিসিভ করতে এসে প্রতিনিয়ত মানুষকে হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।
সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। স্বজনদের প্রবেশ করতে না দেয়ার ফলে যাত্রীদের নানা সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। জয়নাল আবেদীন নামের এক ব্যক্তি জানান, গত ২ ফেব্রুয়ারি তার ছোট ভাইকে বিদায় দিতে সকাল ১০টায় বিমানবন্দরে আসেন। কিন্তু প্রবেশ পথেই পুলিশ তাদের আটকিয়ে দেয়। পরে গাড়ি থেকে নেমে তিনি ও তার সঙ্গে আসা ফরিদুল আলম নামের ব্যক্তিটিকে বিমানবন্দরের বাইরে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ফরিদুল আলম জানান, তার মেয়ে সাউথ আফ্রিকার সোয়াজিল্যান্ডে স্বামীর কাছে যাচ্ছিল। সে ইতিপূর্বে কখনো বিদেশ যায়নি ফলে তাকে নানা সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। তিনি আরো জানান, কক্সবাজারের মহেশখালীতে তাদের বাড়ি। হরতাল-অবরোধের কারণে দু’দিন আগে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। তিনি দুঃখ করে বলেন, মেয়ের সাথে ২টি লাগেজ ছিল। জেট এয়ারওয়েজে ওইদিন দুপুর ১টা ১০ মিনিটে ফ্লাইট ছিল। কিন্তু লাগেজে মালামাল বেশি হওয়ায় অর্ধেক মালামাল প্রয়োজনীয় জামাকাপড় বিমানবন্দরে রেখে যেতে হয়। বোর্ডিং পাস নেয়ার পর মেয়ে মোবাইল ফোনে জানায়, লাগেজে অর্ধেক মালামাল রেখে যেতে হচ্ছে। ফরিদের অভিযোগ, অনেক অনুরোধ করেও তিনি এসব মালামাল আনার জন্য বিমানবন্দরের দু’তলায় ৩ নম্বর গেটে যেতে পারেন নি। তাকে ভেতরে যেতে দেয়া হয়নি। এভাবে প্রতি দিনই শ শ মানুষকে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
যাত্রী ও স্বজনদের অভিযোগ সম্পর্কে সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম সানাউল হকের দপ্তরে একাধিকবার গিয়েও তার বক্তব্য জানা যায়নি । দপ্তর থেকে জানানো হয় তিনি মিটিংয়ে আছেন।
আতিক /প্রবাস