তৃতীয় দিনের খাবারও নিয়ে গেছে গুলশান পুলিশ চারদিকে ধিক্কার

প্রবেশের ‘উপর’ নিষেধাজ্ঞা। প্রস্থানের পথেও কাটা। আহার-পানির চোখে দেখা মিললেও মুখের কাছে যেতে বাধা। গত বুধবার থেকে তিন দিন ধরে খাবার-পানি প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে ভাত-পানিতে মরতে হচ্ছে। মরণব্যাধির ওষুধ-পথ্যও ঠিকমতো মিলছে না। এমন বৈরী পরিস্থিতিতে দিনাতিপাত করছেন অন্তত ৫৬ জন। তাঁরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। কেউ দলীয় নেতা, কেউ খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব ও উইং সদস্য, ব্যক্তিগত সহকারী এবং অন্যরা আছেন নিরাপত্তার দায়িত্বেও। ইতিপূর্বে অন্ধকারে রাত কেটেছে, বিচ্ছিন্ন আছে দূরালাপনী-ক্যাবল লাইনও। এই কার্যালয়ের একটি কক্ষে দীর্ঘ ৪০ দিন পার করছেন বেগম খালেদা জিয়া। তার সাথে দেখা করতে গিয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত ছাত্রদল নেতা নূরুজ্জামান জনির স্বজন নিশিতাকে। অবশ্য আটকের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে জনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও পিতা-মাতাকে।
এদিকে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে খাবার সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সমালোচনায় মুখর মানবাধিকার সংস্থাসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও।
গুলশান-২ সেকশনের ৮৬ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়িটি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে ভাড়ায় নিয়েছেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। অপরিচিত এই বাড়িটি এখন শিরোনাম হচ্ছে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে। আন্দোলন সংগ্রামে ইতিহাসের উপাদান হিসেবেও স্থান পাচ্ছে।
তিনদিন ধরে অভুক্ত এই কার্যালয়ের কয়েকজন বলেন, সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকারী বেগম খালেদা জিয়ার জন্যই গর্বের সাথে এই অবর্ণনীয় কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করছি। যারা এ অবস্থায় রয়েছি অতীতের মতো আগামীতেও কোন চাওয়া-পাওয়ার নেই। তবে তার আন্দোলনে শরিক হতে পেরে ধন্যও মনে করছি।
বৈরী পরিবেশের বর্ণনা দিয়ে তারা আরো বলেন, বিরাজমান অবস্থায় সেই কারবালার ইতিহাস মনে হচ্ছে। জালিম ইয়াজিদ ফোরাত নদের পানি বন্ধ করে দিয়েছিল। কানে বাজছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের বাক্যগুলোও। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জ্বালাময়ী ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘— তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, রাস্তাঘাট বন্ধ করে দাও, আমরা ভাতে মারব। পানিতে মারব’। এদিকে বিএনপির মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহম্মেদ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ক্ষমতাসীনদের প্রতি। বলেছেন, ৭ খুনের ঘটনার নায়ক তারেকরা জামাই আদর পায়। আর বিনাদোষে গৃহবন্দি সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রীসহ ৬০ জন মানুষকে ভাতে-পানিতে মারা হচ্ছে। কড়ায় গ-ায় এর পরিণাম ভোগ করতে নেপথ্য নায়কদের প্রস্তুত থাকার জন্য হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সাবেক এই এমপি।
কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থানকারী বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইং সদস্য শামসুদ্দিন দিদার জানান, গতকাল (শুক্রবার) দুপুর একটার দিকে কার্যালয়ের ভেতরে যারা আছি তাদের জন্য দুপুরের খাবার আনা হয়। সেগুলো নিজেদের টাকা দিয়ে কেনা খাবার। কিন্তু দায়িত্বরত গুলশান থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা খাবার নিতে বাধা দেন। তিনি মোবাইলে কারো সাথে কথা বলে কার্যালয়ের ভেতর খাবারগুলো নিতে দেননি। একপর্যায়ে খাবারসহ ভ্যানগাড়িটি ফেরত পাঠান তিনি। সে সময় দিদার ওই পুলিশ কর্তার উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের টাকায় কেনা খাবার কার্যালয়ে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন? সেগুলো তো আমাদের রিযিক। আল্লাহ ছাড়া সেখানে কারো হাত দেয়ার অধিকার নেই। আমরা তো কারারুদ্ধ না। মৃত্যুদ- দেয়া হলেও তো ওই ব্যক্তিকে চাহিদামতো খাবার দেয়া হয়। তাহলে আমরা কোন রাজ্যে বাস করছি? এই নির্মমতার শেষ কোথায়? তবে পুলিশ কর্মকর্তা কোনো উত্তর দেননি বলে জানান দিদার। বেশ কিছুক্ষণ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রেখে পরে গুলশান থানা পুলিশ এসে সেগুলো নিয়ে যায়।
খাবার নিতে না দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দায়িত্বরত পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, উপরের নির্দেশ ছাড়া খাবারের ভ্যান ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না। গত বুধবার রাত থেকে কার্যালয়ে স্টাফদের জন্য কোনো খাবার নিতে দিচ্ছে না পুলিশ। তবে চেয়ারপারসনের খাবার যেতে বাধা দিচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, সত্যিকার অর্থেই যদি খাবার প্রবেশ করতে দেয়া না হয়। তাহলে এই ঘটনার নিন্দা অবশ্যই জানাই। এমন অমানবিক কর্মকা- রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা করি না। কারাগারের সাজাপ্রাপ্ত আসামি পর্যন্ত খাবার পাওয়ার অধিকার আছে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে খাবার প্রবেশে বাধা দেয়ার বিষয়টি অনভিপ্রেত অনাকাক্সিক্ষত।
প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, খাবার প্রবেশে বাধা দেয়ার ঘটনাটি খুবই অন্যায়। এর চেয়ে জঘন্য আর কিছু হতে পারে না। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
গত ৩ জানুয়ারি থেকে বেগম খালেদা জিয়া তার গুলশান কার্যালয়ে। এ সময়ের মধ্যে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশি বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ হন তিনি। পরে সেখান থেকে সব ধরনের ব্যারিকেড গভীর রাতে প্রত্যাহার করা হয়। সেই থেকেই খালেদা জিয়া কার্যালয়েই আছেন। সেখানে তার সাথে আছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম, চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান,
বিশেষ সহকারী এডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, মাহবুব আলম ডিউ, নিরাপত্তা সমন্বয়কারী মেজর (অব.) আব্দুুল মজিদ, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান, শামসুদ্দিন দিদারসহ নেতা-কর্মী ও কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ৫৬ জন।
মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মানুষ কতোটা বর্বর হয়; বর্তমান আওয়ামী লীগ তার উদাহরণ। তিনি বলেন, ভাত-পানি বন্ধ করে আমাদেরকে নেত্রীর পাশ থেকে সরানোর অপকৌশল ভেস্তে যাবে। জন্ম-মৃত্যু, আহার-নিন্দ্রার ফায়সালাতো সরকার করে না। করেন মহান আল্লাহ।
বৈরী পরিবেশ মোকাবিলায় পদ্য দিয়ে মনোভাব প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, একটি জমাট দীর্ঘশ্বাসে/ তোমার কুটিল বিশ্বাসঘাতকতার সব মূল্য নিপাট চুকিয়ে দিয়ে/সহসাই নেবো বুকে শ্যামল সুস্থতা/ মুছে যাবে অনেক দিবারাত্রির কলঙ্কিত দীর্ঘশ্বাসের দাগ।
প্রেস উইং সদস্য শাইরুল কবির খান বলেন, ৭ মার্চে শেখ মুজিব দেশ স্বাধীনের জন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ভাতে পানিতে মারার ঘোষণা দিয়েছিল, এখন দেশ স্বাধীন কিন্তু তাদের ফ্যাসিবাদী আচরণের মধ্যদিয়ে নতুন প্রজন্ম অবহিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ কি। প্রেসিডেন্টের স্ত্রী তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর ৪০ দিন ধরে একটি কক্ষে দিনাতিপাত করার কষ্ট আমাদের কষ্টকে ম্লান করে দেয় বলেও জানান তিনি।

আতিক/প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.