টিভি টকশো আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে!

‘স্যার টিভির খবর কী দেখবেন, বেসরকারি সব টিভি কয়েকদিন থেকে বিটিভি হয়ে গেছে’ এভাবে আক্ষেপ করলেন এক চা বিক্রেতা। বৃহস্পতিবার মতিঝিলের একটি টিভি কোম্পানির শো রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন পথচারী খবর দেখছিলেন। খবরের এক ঝলক দেখেই চা বিক্রেতা এ উক্তি করে বলেন, স্যার আমি টিভির টকশো দেখি। টকশো দেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম; প্রধানমন্ত্রীর টকশোওয়ালাদের বিরুদ্ধে কঠোর বক্তব্য দেয়ার পর আবার টকশো দেখা শুরু করেছি। কয়েকদিন আগে শনির আখড়ার চা দোকানদার জহির পরামর্শ দিয়ে বলেছিল ‘স্যার দেশের প্রকৃত খবর জানতে হলে বিবিসি শোনেন। ঢাকার চ্যানেলগুলোতে প্রকৃত খবর পাবেন না।’ দুই চা বিক্রেতার কথায় বোঝা গেল দেশে ইলেক্ট্রনিক্স চ্যানেলে বিপ্লব ঘটে গেলেও খবরের বস্তুনিষ্ঠতায় দর্শকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
দেশের প্রকৃত চিত্র জানতে বিদেশি গণমাধ্যম বিবিসি, সিএনএন এবং আল জাজিরা দর্শন ইদানিং বাড়ছে। পাশাপাশি দেশের টিভি টকশো আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। টকশো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার পর কার্যত টকশোর নিচে নামা জনপ্রিয়তার পারদ আবার উপরে উঠতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিষয়ভিত্তিক টকশোগুলোতে আলোচকদের মান যাই হোক দর্শক বৃদ্ধি পাচ্ছে। টকশোয় বিজ্ঞাপন বাড়ছে ব্যবসা হচ্ছে। রাজনীতি এবং ভোটের অধিকার সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এটা হয়েছে। বিগত ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যক্তি মালিকানার টিভিগুলোতে টকশো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। নীতিবান, নির্ভীক, সত্যবাদী, উন্নত নীতিজ্ঞান, নৈতিকতা সম্পন্ন ও আদর্শ ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেশবাসীর কাছে সুপরিচিত শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সুশীল, এনজিও নেতা, আইনজীবীরা টকশোতে অংশ নেয়ায় অনুষ্ঠানগুলো জনপ্রিয়তা পায়।

মরহুম সাংবাদিক এবিএম মুসা ও অধ্যাপক পিয়াস করিম ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। বড় দুই দলের নেতা এবং তাদের সুবিধাভোগী অনুগত বুদ্ধিজীবী-সুশীলরা তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া, চোখ তুলে নেয়ার হুমকি এবং মারমুখী হয়ে ঝগড়াফ্যাসাদ করলেও টকশোর দর্শক সংখ্যার পারদ উপরে উঠতেই থাকে। তবে নাম, পরিচয়, গোত্রহীন কিছু প্রধানমন্ত্রীর বিদ্রƒপে ‘টকশো’ ব্যক্তি টকশোয় নিয়মিত মুখ হওয়ায় মাঝখানে টকশোর প্রতি অনেক দর্শকের আগ্রহ কমে যায়। নানাভাবে তার প্রকাশও ঘটে।

রাজনীতির আলোচনা জনপ্রিয় হয়ে উঠায় নাটক সিনেমার মতো বিনোদনধর্মী অনুষ্ঠানের চেয়ে টিভির মালিকপক্ষ ব্যবসায়িক স্বার্থে টকশোর প্রতি জোর দেয়। বিদেশি টিভিগুলো অনুকরণে ভিন্ন ভিন্নভাবে সাজানো হয় নানান রঙের টকশো। আলোচনা ও টকশো মানসম্পন্ন চ্যানেলগুলোতে দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ায় নি¤œমানের চ্যানেলগুলোও টকশো শুরু করে। আর এ সুযোগে হঠাৎ করে গজিয়ে উঠে দেশে টকশো কেন্দ্রিক কিছু বুুদ্ধিজীবী।

জীবনে কোনোদিন কেউ নামও শোনেননি তারা টকশোতে সবজান্তার মতো জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেন। রাজনীতির ‘র’ অর্থনীতির ‘অ’ বোঝেন না তারাও রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা করে জাতিকে জ্ঞান দেন। বাপ-দাদার সমবয়সী মুরুব্বীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। জনপ্রিয় কয়েকটি চ্যানেল বিভিন্ন টকশোয় রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের এনে তাদের জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা দর্শকদের উপহার দেন। তাদের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা অনেক ক্ষেত্রেই সরকার ও সরকারি দলের জন্য অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতানেত্রীরা এসব ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেন। আবার টকশোতে নিয়মিত অংশ নেয়া অনেক আলোচককে হুমকি-ধামকি, গাড়ি ও বাসায় বোমা নিক্ষেপ, পরিবারের সদস্যদের গুম করার হুমকির ঘটনাও ঘটে। এসব কারণে বিভিন্ন বিষয়ের প-িতজনদের বড় একটা অংশ টকশোতে আসতে আগ্রহী হন না।

আবার দেশের অধিকাংশ টিভি চ্যানেলের মালিক ব্যবসায়িক স্বার্থে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অনুগত এবং এসব ব্যক্তি বিষয়ে সরকারি দলের শীর্ষ নেত্রীর মনোভাবও প্রতিকূল বিধায় দল নিরপেক্ষ এবং যাদের চাঁচাছোলা কথায় সরকার বিব্রত হতে পারেন, অনুষ্ঠানে তাদের আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। মালিকপক্ষের এ ধরনের সাবধানতা ও সতর্কতার কারণে টকশোতে নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার মাধ্যমে যেসব আলোচক শ্রোতা-দর্শকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকেন তাদের আমন্ত্রণ জানানোর সাহস দেখান না। তাছাড়া প্রতিটি টিভি চ্যানেলের ওপর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অলিখিত নজরদারি রয়েছে। আছে গ্রেফতার এবং নানাবিধ হয়রানির ভয়।

এ কারণে যেসব আলোচক নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ আলোচনায় সরকার বিব্রতকর ও অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে, তাদের আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহী হন। অধ্যাপক আসিফ নজরুল, নুরুল কবির, আসাফউদ্দৌলা, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মতো আলোচকদের ইদানিং টকশোতে কমই দেখা যাচ্ছে। ব্যক্তিত্ব ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে যারা নমনীয় এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে কার্যপালনে বিবেক বাধা দেয় না তাদের কদর বেড়ে যায়। এ ধরনের আলোচকদের ‘নিরপেক্ষতার লেবেল’ দিয়ে মালিকপক্ষ পছন্দের তালিকায় এনে টকশো করছেন। ফলে মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ, অধ্যাপক মেজবা কামাল, অধ্যাপক জিয়াউর রহমান, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, নাইমুল ইসলাম খান, অধ্যাপক গোলামুর রহমানসহ বামপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের কাউকে কাউকে একই দিন ৩ থেকে ৫টি টকশোতে দেখা যায়। এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীরা সীমার মধ্যে থেকে ‘টকশোয় নিজেদের বাজার’ ধরে রেখেই সরকারের সমালোচনা করেন।

তবে কারণে অকারণে বিএনপিরও বিরোধিতা এবং জামায়াতের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে নিরপেক্ষতা জাহির করেন। আর সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে আওয়ামী লীগের অন্ধ স্তবক হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক আবদুল মান্নান (চবি সাবেক ভিসি), অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন (জাবি সাবেক ভিসি), ড. মিজানুর রহমান (জবি ভিসি), অধ্যাপক শফিউর রহমান ভূঁইয়া, অধ্যাপক সাদেকা হালিম এবং টকশোর মাধ্যমে হাইব্রীড বুদ্ধিজীবীখ্যাত মোজাম্মেল বাবু (৭১ টিভির মালিক), সুভাস সিংহ রায় (হলমার্ক কেলেঙ্কারির সময় সোনালী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন), মোহাম্মদ এ আরাফাত প্রমুখরা প্রতিদিন কোনো না কোনো টিভি টকশোতে রয়েছেন। অমুককে নিতে হলে তমুককে নিতে হবে এমন নাকি অলিখিত বাধ্যবাধকতার শর্ত দেয়া হয় মাঝে মাঝে।

এই স্তবকদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিতে অভ্যস্ত স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন কিছুদিন আগে একুশে টিভির এক টকশোতে বলেছিলেন, ৫ জানুয়ারিতে নির্বাচনের নামে প্রহসন না হলে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে অজ্ঞই থেকে যেতাম। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে এ দাবিতে এরা টকশোতে তর্ক করেন, ভোটের অধিকারের চেয়ে তারা এখন উন্নয়নে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দাবি করেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শে বিশ্বাসের দাবি করেন অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কর্ম করেন। এদের ভিতরটা ভয়ঙ্কর কদাকার আগে বুঝতে পারিনি। ৫ জানুয়ারি না এলে জানতে পারতাম না। আবার টকশো অনুষ্ঠানের এমন কিছু প্রযোজক ও উপস্থাপক রয়েছেন যারা অতিথি আমন্ত্রণ বিষয়ে ব্যক্তিগত লাভের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিয়ে থাকেন।

পাশাপাশি তারা নিরপেক্ষ রেফারির বদলে অহেতুক পছন্দের পক্ষ নিয়ে আলোচনায় হস্তক্ষেপ করে থাকেন। এমন কিছু আলোচককে টকশোতে আনেন যারা টকশোয় অংশগ্রহণকে তাদের প্রচার ও সমাজে ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে দেখেন। এ ধরনের আলোচকদের আলোচনা শ্রোতা-দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য নাকি অগ্রহণযোগ্য সেটি অনেক প্রযোজক ও উপস্থাপকের কাছে গৌণ। তাদের কাছে মুখ্য হচ্ছে তাদের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধি। তারপরও টকশোগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। যারা রাতের টকশো দেখার চিন্তুাও করতেন না তাদের কেউ কেউ রাত জেগে টিভি দেখেন। টকশোর আলোচকদের টক-ঝাল-মিষ্টি কথা শোনেন। নিজেরা তর্কবিতর্ক করেন। এ নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টকশো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিরূপ মন্তব্য করায় টকশোর প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যায়।

আতিক / প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *