বহুদিন ধরেই দেশের বেশিরভাগ কারগারে ধারণক্ষমতার চেয়ে বন্দির সংখ্যা বেশি। তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর প্রতিদিনই মিছিলের মতো বন্দি আসছে। চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় নাশকতা আর সহিংস ঘটনা প্রতিহত করার নামে দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘গণগ্রেফতার’ অভিযান চালানোয় দেশের কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে।
দেশের ৬৮টি কারাগারের চিত্র প্রায় একইরকম। অতিরিক্ত বন্দির চাপে বেকায়দায় পড়ে গেছেন কারা কর্তৃপক্ষ। বিপুলসংখ্যক বন্দির সংস্থানে হিমশিম খাচ্ছে তারা। তবে সবচেয়ে বাজে অবস্থার মধ্যে রয়েছেন বন্দিরাই। বন্দিদের দেওয়া খাবারের মান কমে গেছে। বাড়ছে নোংরা-আবর্জনা। রাতে মেঝেতে শুয়ে পাশ ফেরারও সুযোগ পাচ্ছেন না কারাবন্দিরা।
কারা অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি দিন যে হারে বন্দি কারাগারে আসে প্রায় একই হারে ছাড়া পায়। ফলে বন্দির সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে রাখা যেত। কিন্তু গত এক মাসে প্রতি দিন যে হারে বন্দি আসছে তার তুলনায় জামিনে বের হচ্ছেন খুবই কম। ফলে হাজতি-বন্দির সংখ্যা প্রতি দিনই বাড়ছে।
দেশের প্রতিনি কারাগারেই এখন ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি বন্দি অবস্থান করছেন। দেশের মোট ৬৮টি কারাগারের ধারণক্ষমতা হলো ৩৪ হাজার ১৬৭ জন। স্বাভাবিক অবস্থায় এসব কারাগারে বন্দি সংখ্যা থাকে ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার। কিন্ত কারা অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কারাগারগুলোতে বর্তমানে বন্দি আছে ৭৫ হাজার ৫৮০। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি বা কয়েদি ১৮ হাজার ৭৬০ জন। বাকি ৫৭ হাজার ৭৩০ জন হলেন বিচারাধীন বন্দি বা হাজতি। একজনের স্থলে থাকতে হচ্ছে পাঁচজনকে। ফলে পাশ ফিরে শোয়ার সুযোগ মিলছে না বন্দিদের। তৈরি হয়েছে মানবেতর পরিস্থিতি।
বন্দিদের চাপে সবচেয়ে বাজে অবস্থা তৈরি হয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। এতে বন্দির ধারণক্ষমতা ২ হাজার ৬৮০ জন। বর্তমানে সেখানে অবস্থান করছেন প্রায় নয় হাজার বন্দি। প্রতিদিনই ১০০ থেকে ১৫০ বন্দি এখানে বেড়েই চলেছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মঙ্গলবার জামিনে ছাড়া পাওয়া বন্দি বাড্ডার নূরু মিয়া জানান, তাকে রন্দি রাখা হয়েছিল কারাগারের মনিহার ভবনে। দ্বিতীয়তলার যে কক্ষে তিনি অবস্থান করছিলেন তাতে দাগ কেটে সংখ্যা লেখা রয়েছে ৭৪। অথচ সেখানে অবস্থান করছেন তিনশ’রও বেশি বন্দি। ওই কক্ষে গাদাগাদি করে শোয়াটাও মুশকিল, তাই শোয়া নিয়ে প্রতিদিনই লেগে যাচ্ছে ঝগড়া-বিবাদ। ওই ওয়ার্ডে রয়েছে একটা মাত্র টয়লেট। তাতে সকাল থেকেই থাকে লম্বা লাইন। নিম্নমানের মোটা চালের ভাত পর্যাপ্ত দেওয়া হলেও তরকারীর পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ায় খিদে নিয়েই অর্ধভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাতে হচ্ছে। সব ওয়ার্ডেরই একই অবস্থা। চরম কষ্টে মধ্যে আছে বন্দিরা।
একই চিত্র দেশের অন্য কারাগারগুলোতেও। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ধারণক্ষমতা ১ হাজার ৮৫৩ হলেও রয়েছেন প্রায় ৬ হাজার বন্দি। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে ১ হাজার ৪৭৭ জনের স্থলে অবস্থান করছেন ৩ হাজারের বেশি বন্দি। রাজনৈতিক বন্দি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় কারাগারের বারান্দা, বাথরুমের সামনে এমনকি ফাঁকা স্থানেও তাঁবু টানিয়ে বন্দি রাখা হচ্ছে। এতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার বন্দি। এছাড়া অতিরিক্ত বন্দি থাকায় কারাগারের ভেতরে ও বাইরের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
রাজনৈতিক বন্দিদের নিয়মিত বিভিন্ন কারাগারে বদলি করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বন্দিদের গাজীপুরের কাশিমপুরে হাইসিকিউরিটি কারাগারে রাখা হচ্ছে। কারাগারগুলোতে রাজনৈতিক বন্দি বেড়ে যাওয়ায় বন্দি ব্যবস্থাপনায় বেগ পেতে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। বন্দিরা যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে কারা কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দারা।
কারা সূত্রে জানা গেছে, ‘গণগ্রেফতার’ অভিযানে গ্রেফতার বেশিরভাগ বন্দি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক। রাজনৈতিক কারণে নানা মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৮ কারাগারেই এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই অবস্থা বিরাজ করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারাগারে রাজনৈতিক বন্দির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। যদিও স্বাভাবিক সময়ে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি বন্দি থাকে, কিন্তু জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হলে পর্যায়ক্রমে উদ্বেগজনক হারে চাপ বাড়ছে কারাগারগুলোতে। এক মাসে কারাগারে যেসব বন্দি এসেছেন তার মধ্যে ৮০ শতাংশ রাজনৈতিক মামলার আসামি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এত বেশি সংখ্যক বন্দির সংস্থানে কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে জানতে চাইলে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন জানান, ‘আগে থেকেই কারগারগুলোতে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দি ছিল। তখনও তাদের থাকা-খাওয়া ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এখন ধারণক্ষমতার তিনগুণ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে চারগুণ হয়েছে। ফলে একজনের জায়গায় তিনজন করে থাকতে হচ্ছে। এতে সমস্যা তো কিছু হবেই। বন্দি সংখ্যা যত বেশিই হোক তাদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সবসময়ই সচেষ্ট আছে কারা কর্তৃপক্ষ।
Mizanur Rahaman liked this on Facebook.
Rashed Jamal liked this on Facebook.
Monirul Islam liked this on Facebook.
Md Azizul liked this on Facebook.
খালেদ পাভেল liked this on Facebook.
অনিতাভ শিকদার liked this on Facebook.
Manzur Ahmed liked this on Facebook.