চট্টগ্রাম: বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের টানা হরতাল-অবরোধে নগরীতে চলমান নাশকতায় নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনের অনুসারীদের সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। নগরীতে পেট্রোলবোমা ও ককটেল হামলার ঘটনায় আটক আসামিরা আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এমন দাবিই করেছে।
তবে স্বীকারোক্তিতে কেউ সরাসরি ডা. শাহাদাতের নাম উল্লেখ না করলেও পুলিশের দাবি, নগরীতে নাশকতা ডা. শাহাদাতের অর্থে ও নির্দেশনায় হচ্ছে।
সোমবার সকালে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম সৈয়দ মাশফিকুল ইসলামের আদালতে বাকলিয়া থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া দুই বিএনপিকর্মী ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পেট্রোলবোমাসহ গ্রেপ্তার হওয়া কবির হোসেন (১৮) ও সোহেল (১৮) নামের দুই বোমাবাজ তাদের দেয়া স্বীকারোক্তিতে দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি নবাব খানের নির্দেশে ও অর্থায়নে নাশকতা করছেন বলে জানিয়েছেন। নবাব খান ডা. শাহাদাত হোসেনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এবং তারা একই এলাকার বাসিন্দা।
এছাড়া গত শনিবার রাতে নগরীর আলমাস সিনেমার সামনে থেকে ১৮টি ককটেলসহ ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সিএনজি অটোরিকশা চালক মুজিবুর রহমানও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হামলার নির্দেশদাতা ও অর্থদাতা হিসেবে ডা. শাহাদাতের অনুসারীদের নাম বলেছেন।
জবানবন্দিতে সোহেল ও কবির জানিয়েছেন, ককটেল, পেট্রোলবোমা হামলার সঙ্গে দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি নবাব খান ও তার অনুসারী শফিক, জাহাঙ্গীর, ফিরোজ বাবু ও ফারুক জড়িত।
তাদের গত ১৮ জানুয়ারি নগরীর বাকলিয়া থানার ইছাহাকের পুল এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। এসময় তাদের কাছে একটি বাজারের ব্যাগে দু’টি পেট্রোলবোমা, একটি ককটেল ও একটি গ্যাস লাইটার পাওয়া যায়। বাকলিয়া থানা পুলিশ প্রথমে তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেয়ার পর সোমবার তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক এ জবানবন্দি দেয়।
জবানবন্দিতে সোহেল জানিয়েছেন, তিনি বাকলিয়া থানার বৌবাজারে একটি ঝুট কাপড়ের দোকানে কাজ করে। ১৮ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টার দিকে দোকান বন্ধ করার পর নবাব খানের অনুসারী ফারুক তাকে ফোন দিয়ে একই ওয়ার্ডের ময়দার মিল এলাকায় যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার সময় সোহেল তার বন্ধু কবিরকেও সঙ্গে নেন। ময়দার মিল এলাকায় যাওয়ার পর ফারুক তাদের নিয়ে চাক্তাই এলাকায় একটি স্কুলের মাঠে যায়। সেখানে আগে থেকেই নবাব খানের সহযোগী শফিক, জাহাঙ্গীর, বাবু ও ফিরোজসহ আরও তিন-চারজন অবস্থান করছিল।
জবানবন্দিতে সোহেল আরো জানান, স্কুল মাঠে সোহেল ও কবিরকে একটি বাজারের ব্যাগ দেয়া হয়। ব্যাগে দু’টি পেট্রোলবোমা, একটি ককটেল এবং একটি গ্যাস লাইটার ছিল। ফারুক তাদের ব্যাগটি নিয়ে কালা মিয়া বাজার যেতে বলে এবং সেখানে গেলে তাদের কাছ থেকে কয়েকজন এসে ব্যাগটি নিয়ে যাবে বলে জানানো হয়। এসময় তাদের চা-নাশতা করার জন্য পাঁচশ টাকা দেন ফারুক। এরপর ফারুক ব্যাগটি দেয়ার সময় নবাব খানকে ফোন করে ব্যাগটি বুঝিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সোহেল জবানবন্দিতে আরও জানান, চাক্তাই স্কুল মাঠ থেকে সোহেল ও কবির একটি রিক্সায় করে রওনা দেয়। কালা মিয়া বাজার এলাকায় শফিক, জাহাঙ্গীর, বাবু ও ফিরোজের সঙ্গে তাদের আবারও দেখা হবে বলে ফারুক জানিয়েছিল। কিন্তু এর আগেই রিক্সাটি ইছাহাকের পুল অতিক্রমের সময় সোহেল ও কবির পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
এদিকে গতকাল রোববার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে একই আদালতে কোতোয়ালি থানার একটি মামলায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সিএনজি রিকশা চালক মুজিবুর রহমান জানিয়েছেন, শনিবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার দিকে যুবদল কর্মী রাসেল তাকে ফোন করে অটোরিক্সা নিয়ে ডবলমুরিং থানার মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসের পেছনে যেতে বলেন। এসময় রাসেল সিএনজি চালক মুজিবকে বলেন, ‘আলী মর্তুজা ভাই (নগর ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক) তাকে কিছু জিনিস দেবেন।’
তিনি জবানবন্দিতে আরো জানান, মুজিব নির্দেশমত সিএনজি রিকশা নিয়ে মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন একটি ক্লাব ঘরে যায়। সেখানে তাকে দু’টি রংয়ের বড় কৌটা দেয়া হয়। একটি কৌটায় ১৮টি করে ককটেল ছিল। অটোরিক্সাটি নিয়ে সার্কিট হাউস পর্যন্ত আসার পর রাসেল একটি কৌটাভর্তি ককটেল নিজের হেফাজতে নেয়। এরপর আরেক যুবককে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটারিচালিত রিক্সায় চড়ে নিউমার্কেটের দিকে চলে যান রাসেল। মুজিবুর অটোরিক্সা নিয়ে আলমাস মোড় অতিক্রমের সময় পুলিশের চেকপোস্টের সামনে পড়ে যায়। পরে ডিবি পুলিশের একটি দল তল্লাশি করে ককটেল ভর্তি রংয়ের কৌটাটি পায় এবং চালক মুজিবকে আটক করে।
এই আলী মর্তুজা ও যুবদল কর্মী রাসেল নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনে অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তারা নগরীর এনায়েত বাজার এলাকার বাসিন্দা।
বাকলিয়া থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘বাকলিয়া এলাকা সহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে চলমান নাশকতায় ডা. শাহদাত হোসেনের অনুসারীরাই জড়িত। মূলত তার নির্দেশনা ও অর্থায়নেই পেশাদার অপরাধীরা এসব নাশকতা করছে।’
অভিযোগ প্রসঙ্গে নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নবাব খান ও গোলাম মর্তুজার সম্পৃক্ততার কথা পুলিশ আটক হওয়া কয়েকজন বস্তির ছেলের মাধ্যমে জোর করে বলিয়েছে। সরাসরি বোমা হামলার ঘটনা থেকে কাউকে আটক না করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির নামে যেসব নাম বলানো হচ্ছে, তা ব্যক্তি স্বার্থে ও সরকারের নির্দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি করার জন্যই।’
আদালেত যাদের নাম উঠে এসেছে তারাতো আপনারই অনুসারী হিসেবে পরিচিত? এই প্রশ্নের উত্তরে শাহাদাত বলেন, ‘আমি ২৮ বছর ধরে রাজনীতি করি। এসব সহিংস রাজনীতির সঙ্গে আমি জড়িত নয়। আর যাদের নাম আদালতে উঠে এসেছে তারা ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি কিংবা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে আমার অনুসারি হওয়াটাতো স্বাভাবিক। তবে আমার ব্যক্তিগত কোন বাহিনী নেই। সে হিসেবে নাশকতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন সম্পৃক্ততা নেই।’
Ramzan Ali liked this on Facebook.
Ramzan Ali liked this on Facebook.