বিরামহীন দায়িত্ব পালনে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে পুলিশের সদস্যরা

বিরামহীন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে পুলিশের সদস্যরা। রাজনৈতিক উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলা এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে পুলিশকে দিন-রাত অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের ঘুম নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত সময়মতো হচ্ছে না। টানা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। স্ত্রী-সন্তানের সান্নিধ্যেও যেতে পারছেন না অনেকদিন। অন্যদিকে দায়িত্ব পালনকালে পান থেকে চুন খসলেই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুমকি-ধামকি ও বকা শুনতে হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তবে এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা রয়েছেন আরাম-আয়েশে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, শুধু পুলিশ নয়, র‌্যাব-বিজিবিসহ আমরা সবাই অতিরিক্ত ডিউটি করছি। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে পুলিশকে নিয়মিত ডিউটির বাইরেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। দেশের মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে যা কিছু করার প্রয়োজন র‌্যাব-পুলিশ তাই করবে। যারা নাশকতা করছে মানুষকে পুড়িয়ে মারছে তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে অতিরিক্ত ডিউটি করতে হয়। এত কারো মধ্যে কোন ধরনের ক্ষোভ থাকার কথা নয়। তবে বর্তমানে র‌্যাব-পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে।
পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ইনকিলাবকে বলেন, যে কোন মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া এবং সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করা পুলিশের দায়িত্ব। নাশকতা সৃষ্টিকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতেই পুলিশকে অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে। ফলে পরিশ্রমও বেড়েছে।
পুলিশ সদর দপতর সূত্র মতে, পুলিশ বাহিনীতে ১ লাখ ৫৫ হাজার সদস্য কর্মরত আছেন। তন্মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার সদস্যই বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। ২০ দলীয় জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে গত এক মাস ধরে পুলিশের দায়িত্ব বেড়ে গেছে। নিয়মিত ডিউটির বাইরেও অতিরিক্ত ডিউটিতে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে রাত দিন। পারিবারিক ও সামাজিক কাজ-কর্ম আত্মীয়-স্বজনদের বিয়ে-শাদীতে পর্যন্ত অংশ নিতে পারছেন না তারা। অলিখিতভাবে বন্ধ রয়েছে ছুটি। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ছুটি বাতিল করা হয়নি। রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে কর্মরত প্রায় ২৭ হাজার পুলিশ সদস্যের মধ্যে ২৫ হাজার সদস্যই দিন-রাত মাঠে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের সকল আরাম-আয়েশ বন্ধ। এমন কি পারত পক্ষে ছুটিও পাচ্ছেন না। জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মোঃ মাসুদুর রহমান বলেন, বর্তমানে পুলিশের ডিউটি বেড়েছে সত্য, তবে ছুটি বন্ধ নেই। তিনি বলেন, নাশকতা অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধসহ অপরাধ দমনে পুলিশ ব্যাপক তৎপর রয়েছে। নিয়মিত ডিউটির বাইরেও অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই পুলিশের পরিশ্রম বেড়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যাত্রাবাড়ি থানার একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত ২৫ দিন ধরে টানা ডিউডি করতে করতে এখন ক্লান্ত। সময়মতো খাবারও খেতে পারছি না। ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটছে। দিন-রাত পুলিশের পোশাক পড়ে থাকতে থাকতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে চর্ম রোগ দেখা দিয়েছে। শরীরের ওজন কমে গেছে। এছাড়া মানসিক টেনশনও বেড়েছে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ডিউটি করতে গিয়ে সব সময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হয়। একদিকে দুর্বৃত্তদের পেট্রোলবোমার আতঙ্ক। অন্যদিকে একটু এদিক-সেদিক হলেই স্যারদের বকাবকি। সব মিলিয়ে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। শাহবাগ থানার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাই সর্বদা ভয়ভীতি মনের মধ্যে কাজ করে। কারণ পেট্রোলবোমায় কখন কি হয়ে যায়। পরিবারের লোকজনও আতঙ্কের মধ্যে থাকে।’ উল্লেখ্য, মৎস্য ভবনের সামনে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোলবোমায় দগ্ধ হয়ে গত কয়দিন আগে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
গতকাল উত্তরা আবদুল্লাপুর এলাকায় ডিউটিরত এক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ভাই আমাদের কথা কেউ লিখে না। মানুষের জানমাল রক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য দিন-রাত কাজ করি জীবনবাজি রেখে। তার পরেও সমাজে আমাদের মূল্য নেই।’ ওই কর্মকর্তা দুঃখ করে বলেন, দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করে পুলিশে চাকরি নিয়েছি। আমরাও মানুষ। কিন্তু অনেক সময় মানুষের মর্যাদাটুকু পাইনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে দিন-রাত কাজ করেও কাজের মূল্যায়ন পাচ্ছি না। অথচ অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা মাসের পর মাস শুধু অফিসে বসেই সময় কাটান। আমাদের মতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে-ময়দানে কাজ করাতো দূরের কথা সময়মতো অফিসও করতে হয় না। আরো অনেকেই এ ধরনের অভিযোগ করেছেন।
টঙ্গী থানার একজন এসআই বলেন, ‘ডিউটি করতে করতে এখন বড় বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছি। ছুটি ছাটাও নেই। ঘুম নেই, খাওয়া নেই। আর পারছি না। যদি পরিস্থিতি এ ধরনের থাকে তাহলে চাকরি ছাড়তে হবে।’ তিনি আরো বলেন, তাঁর সহকর্মী ২ জন ইতোমধ্যে জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি নিজেও শ্বাসকষ্ট ও বুকের ব্যথায় ভোগছেন। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ারও সময় পাচ্ছেন না। পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই বলছেন, অতিরিক্ত ডিউটি পালন করতে করতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। যে কোন সময় এ ক্ষেভের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। তারপরেও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশকে হিমশিম খেয়ে হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল ইসলাম বলেন, গত একমাস ধরে পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে কঠোর পরিশম করতে হচ্ছে। দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোলবোমা ও ককটেল বিস্ফোরণে প্রতি দিনই দেশের কোন না কোন এলাকায় পুলিশ সদস্য আহত হচ্ছেন। গত এক মাসে ৩ শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ৬টি মেট্রোপলিটনসহ সারা দেশেই পুলিশের বিশেষ অভিযান চলছে।
একাধিক সূত্র মতে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, সাতক্ষীরা, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি জেলায় অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছে পুলিশ। তারা পরিবার-পরিজনদের সাথেও দেখা করার সুযোগ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ বলছেন, চাকরি জীবনে আর কখনো এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে পরেননি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কথা হয় এ পুলিশ সদস্যের সাথে। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, ‘চাকরিটা ছাড়তেও পারছি না, আবার থাকতেও পারছি না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডিউটি করতে হচ্ছে দিন-রাত। ঘুমানোর সময়টুকু নেই।’ তিনি এভাবেই প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। ডিএমপির একজন উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, চাকরিতে ছোট-বড় বলে কোন কথা নেই। দায়িত্ব পালনে সবাইকে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। আমরা রাষ্ট্রের কর্মচারী, সময়ের প্রয়োজনে অতিরিক্ত ডিউটি করতে হয়। এটা নতুন কিছু নয়।

আতিক/প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *