ভারত কি বাংলাদেশকে নিজের আশ্রিত রাজ্য মনে করে?

ইকবাল চৌধুরী

দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায়, বিনাইল ইউনিয়নের চাপড়া সিমান্তের কাছে, নয়াপুকুর পাড়ে, একটি ধানখেতে। খেতে চারা রোপন করছিলেন এক দিনমজুর, ভোর থেকে, নাম নজরুল ইসলাম (হতভাগাদের নাম খুবই সুন্দর হয়), তাঁর (সম্মানার্থেই চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করেছি) সাথে ছিলো আরও শ্রমিক, তখন সকাল দশটা। গামছার পুঁটলিতে বেঁধে তাঁদের জন্যে খাবার, খাবার মানে মাটন ভূনা চিকেন রেজালা করলা চিংড়ি বেকন টোস্ট নয়, আলুভর্তা ডাল আর মরিচপোড়া, নিয়ে আসেন তাঁদের স্ত্রীরা; তাঁরা খেত থেকে উঠে আসেন আইলে, হাত-মুখ ধুতে যান পুকুরে, আর তখনই ঘটে ঘটনাটি; ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের একদল বর্বর, যাদের কাজ ছিলো দেশমাতৃকার দারোয়ানি ক’রা, বন্দুকের বাট চাটা, চাকুরী না পেলে হয়তো জলপাইগুড়িতে ডাকাতি করতো, শিলিগুড়িতে দালালি করতো হোটেলের, বেটিবাজি করতো কলকাতায়, গু সাফ করতো পুরান দিল্লির মুখার্জি মার্গে, কামলা খাটতো দুবাইয়ে কাতারে লন্ডনে নিউইয়র্কে, গরুপাচার করতো বাংলাদেশে, কমিশনবাজি করতো রিয়েল এস্টেটে, ওরা, ঐ বর্বর মধ্যযুগীয় চামারেরা, হিংস্র চাড়ালেরা, মূর্খ গাড়লেরা, সূতিকাগ্রস্থ বন্দুকীরা, মগজবোঝাই মলেরা, গনোরিয়াগ্রস্থ কলেরারা, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ৫০ গজেরও অধিক অভ্যন্তরে এসে নিরীহ নিরপরাধ নিরস্ত্র দিনমজুর শ্রমিক খেটে-খাওয়া চাষী নজরুল ইসলামদের দিকে তাক করে বর্বর ভারতী রাইফেলের নল।

দিনমজুরেরা আতঙ্কে তটস্থ, তাঁরা ও তাঁদের ভাত-নিয়ে-আসা স্ত্রীরা ভয়ে কাঁপতে থাকে; কে না কাঁপে উদ্ধত বন্দুকের সামনে? মোদী ক্যামেরন ওবামা হাসিনা হিটলার স্তালিন সাদ্দাম আব্দুল্লাহ কার হিম্মত বন্দুকের সামনে সীনা টান ক’রে দাঁড়ায়?

নজরুল ইসলাম হাতজোড় ক’রে কাঁপতে কাঁপতে গলা শুকোতে শুকোতে পড়ে যেতে যতে জিগ্যেস ক’রে, আপনারা? ব্যস, গর্জে উঠলো কালো কুৎসিত অন্ডকোষহীন একপাল ভারতীয় নেকড়ের বন্দুক, মাটিতে লুটিয়ে পড়লো হতভাগ্য বাংলাদেশি নাগরিক (নাগরিকের মর্যাদা কি কখনো তাঁর ছিলো?) নজরুল ইসলাম (আসলে বাংলাদেশ নিজেই)। তাঁর ডাল আলুভর্তা ভাত মরিচপোড়া চিরকালের হাহাকার নিয়ে পড়ে রইলো খেতের ধারে; বর্বরেরা ছেঁচড়ে হিঁচড়ে, তাঁর স্ত্রীর বুকে কষে বিশমণি লাথি মেরে, গুলির পর গুলি ছুঁড়ে, বাংলাদেশকে রক্তাক্ত ক’রে, নিয়ে যায় তাঁর লাশ, এবং ফেরত দেয় পরেরদিন মঙ্গলবার।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, একটি বিদেশি দারোয়ানি বাহিনী যখন এই কাপুরুষোচিত বর্বর প্রস্থরযুগীয় হত্যাকান্ডটি ঘটায়, তখন কার যেন চিকন বালে শ্যাম্পু মাখিয়ে ডিম পাড়া মুরগীর মতো তা দিচ্ছিলো আমাদের অথর্ব বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি); যাদের ডিজি কিছুদিন আগেই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন- বিজিবির সব অস্ত্রই লিথাল বা প্রাণঘাতী! আমার জানতে ইচ্ছে ক’রে, ফেলানীরা, নজরুল ইসলামেরা, ও আরও অসংখ্য বাংলাদেশীরা, যখন সীমান্তে অসহায় হরিণীর মতো প্রাণ হারায়, তখন আমাদের তাগড়া মাংসল পেশীবহুল জওয়ানদের প্রাণঘাতী লিথাল অস্ত্রগুলো কোথায় থাকে? ওগুলোর শিশ্ন কি তখন উত্থিত হয় না?

সর্বশেষ চীনাসম্রাট হেনরি পুইয়ের কথা মনে পড়ছে; ওঁই বদমাশকে যখন ছেঁচা মেরে গদিছাড়া করা হয়, তখন জাপানীরা তাঁকে মাঞ্চুয়োকোর শাসক (আসলে দালাল শাসক) নিয়োগ ক’রে। মাঞ্চুয়োকো, যা চীনেরই অংশ, ছিলো তৎকালীন জাপান সাম্রাজ্যের ‘পাপেট স্টেট’ বা ‘পুতুল রাষ্ট্র’, এবং এককালের চীনাসম্রাট পুই হয়ে উঠেছিলেন জাপানিদের ঐ পুতুল রাষ্ট্রের পুতুল শাসক।

বিএসএফ কি বাংলাদেশকে ভারতের পাপেট স্টেট মনে ক’রে? শেখ হাসিনা কি বাংলাদেশের পুই হয়ে উঠেছেন? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের একটি সুন্দর ভূমিকা ছিলো, যা আমরা বহুবার বহু উপায়ে স্বীকার করেছি, ও শ্রদ্ধা করেছি, এবং এই ঐতিহাসিক অংশটুকো বাদ দিলেও ভারতের সাথে আমাদের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে; তারা আমাদের প্রতিবেশী, তারা ও আ??Ʈরা পরস্পরের আপদ-বিপদের ভাই। তাদের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরও পুরনো (যদিও ভারত ভ্রমণের একটি তুচ্ছ ভিসাও তারা বাংলাদেশিদের দিতে চান না, চালু করে রেখেছেন দালালবান্ধব ই-টোকেন বাণিজ্য)। আমি কি আশা করতে পারি, কোনো বাংলাদেশি কি আশা করতে পারে, আমাদের একটি নিরীহ চাষা, নিরীহ বোন, তাদেরই গুলিতে প্রাণ হারাবে? পঙ্গু হবে? তাদের জোয়ানেরা কষে লাথি বসাবে আমাদের বধূদের স্তনে? আমি এটা কল্পনাও করি না, আশা তো অনেক দূরের কথা।

আমি আমার ভারতীয় বন্ধুদের বলতে চাই, আপনারা আমাদের মতোই তৃতীয় বিশ্বের মানুষ (আসলে গোলাম); আপনারা পা চাটেন রুশদের, গোপনে মার্কিনিদের, আর মার খান পাকি ও চীনাদের হাতে। আপনাদের বহু নেতা, যারা অমর হয়ে গেছেন, দিনে ব্রিটিশবিরোধী শ্লোগান দিতো, ও রাতে উইলিয়ামদের সাথে মদ খেতো। আমিরাতে কাতারে সৌদিতে কুয়েতে লন্ডনে ম্যানহাটনে টরন্টোতে বার্লিনে আপনারা এখনও আমাদের মতোই কামলা খাটেন, গোলামি ক’রেন, দাসত্বে ভোগেন। আপনাদের বহু নারী এখনও হোটেলে হোটেলে বাজারে বাজারে স্টেশনে স্টেশনে চিৎ হয়, তলপেট দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ ক’রে, নটিবাজি ক’রে, ট্রেনে বাসে ধর্ষিত হয়। আপনাদের উত্তর প্রদেশ, ঝারখন্ড, পুরান দিল্লি, মাল্লাগুড়ি, তামিলনাডু, এরকম আরও পাঁচশো পাঁচহাজার স্থানে এখনো ঝোপ-ঝাড় প্রথা চালু আছে, আমাদেরও আছে। আমরা চাই না আপনারা দাদাগিরি করুন, অন্তর থেকে ‘ভাই’ শব্দটি লালন করলেই আমরা বেশি খুশি হই।

আমাদের একটি সরকার আছে, যদিও এ-সরকারকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার সুযোগ আমি পাই নি, তাদের কাছে আমার একটি দাবি আছে; তারা কি আমাদের জানাবেন, নজরুল ইসলাম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে, স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের প্রতিবাদে, ভারতের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করেছেন কি না? কিংবা করবেন কি না? আমি জানি এটা করার সাহস শেখ হাসিনার ও তাঁর মন্ত্রীদের এই মুহুর্তে নেই, কারণ ঘোড়ার উপরে বসে তো আর ঘোড়াকে লাথি দেয়া যায় না।

নজরুল ইসলাম, তুমি ভুল দেশে জন্মেছিলে; পরবর্তী জন্মে, যদি কখনো জন্মাও, ভুলেও বাংলাদেশে এসো না। এটি আর আমাদের নেই, এটি ভ’রে উঠেছে দালালে আর দালালে, এটি নষ্ট হয়ে গেছে, এর সমস্ত শরীরে ঘা, বলাৎকারে বলাৎকারে এটি পচে গেছে। কিন্তু একটি দালাল আমরা চাই, যে দালালি করবে বাংলাদেশের, বাংলাদেশের মানুষের, আছেন কি কেউ?

১৬ thoughts on “ভারত কি বাংলাদেশকে নিজের আশ্রিত রাজ্য মনে করে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *