খালেদা জিয়ার বিবৃতি,যেকোনো পরিণতির জন্য আমি তৈরি, আন্দোলন অব্যাহত থাকবে

বিএনপির চেয়ারপারসন ও ২০-দলীয় জোটনেত্রী খালেদা জিয়া সবাইকে চলমান আন্দোলন শরিক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত আন্দোলন চলতে থাকবে।
বৃহস্পতিবার বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমানের সই করা এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘সকলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে আন্দোলন চলছে। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলনের ডাক দিয়েছি। যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত এ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামে অবতীর্ণ নেতাকর্মীরা অনেক কষ্ট সয়ে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, গুলি করে আহত করা, পাইকারী গ্রেপ্তার, পুলিশি রিমান্ড ও বাড়িতে হামলার মতো ভয়ঙ্কর ত্রাসের মধ্যেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিরোধী ৩৩ নেতাকর্মীকে হত্যা, গ্রেপ্তার ১৭ হাজার
খালেদা জিয়া বলেন, ‘জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী দ্বারা বেষ্টিত সরকার জনগণের আন্দোলনে ভীত হয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এসব বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দলবাজ ও বিতর্কিত কতিপয় কর্মকর্তার হাতে তুলে দিয়ে চরম জুলুম-নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালানো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘গত ৬ জানুয়ারি দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৩৩ জন বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীকে আওয়ামী সন্ত্রাসী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি, সাজানো বন্দুকযুদ্ধ ও নৃশংস অন্যান্য পন্থায় হত্যা করা হয়েছে। গুলি করে ও অন্যান্য পন্থায় আহত করা হযেছে শত শত নেতাকর্মীকে।’
২০-দলীয় জোটনেত্রী বলেন, আটকের পর নিখোঁজ রয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী। ১৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারের ভয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক লাখ নেতাকর্মী।’
‘অনেকের বাড়ি-ঘরে গভীর রাতে হানা দিয়ে ভাঙচুর, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি মহিলাসহ পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন ও হেনস্তা করা হচ্ছে। এভাবে সারাদেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে’ যোগ করেন তিনি।

নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে একতরফা প্রচারণা
খালেদা জিয়া বলেন, ‘জনগণের ওপর এমন চরম জুলুম-অত্যাচারের পাশাপাশি গণমাধ্যমকে সম্পূর্ণভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আন্দোলনরত বিরোধী দল, জনগণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে একতরফা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সকলের মৌলিক-মানবিক সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন ছাড়া প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম পরিচালনাও অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। অফিস বন্ধ করে দেয়া, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে না দেয়া, এমনকি দলের পক্ষে কেউ বক্তব্য-বিবৃতি দিলেই আটক করে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হেনস্তা করা নিয়মিত রীতিতে পরিণত হয়েছে।’
‘অন্যদিকে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে শাসক দলের সন্ত্রাসীরা লাঠিসোটা এমনকি মারণাস্ত্র নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় প্রকাশ্যে মহড়া দিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা আমাদের দলের সিনিয়র নেতাদের ওপর গুলি করছে। তাদের গাড়ি, বাড়ি ও অফিসে বোমা হামলা চালাচ্ছে’ অভিযোগ বিএনপি চেয়ারপারসনের।

জীবন-বিনাশী ঘৃণ্য হামলা নিয়ে জনমনে সন্দেহ-প্রশ্ন
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা বারবার বলে এসেছি, আমাদের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক। এ আন্দোলন আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়েই অগ্রসর করে নেয়ার নীতিতে বিশ্বাস করি।’
যাত্রীবাহী ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রোল বোমা হামলার হীন ও নৃশংস হামলায় জড়িত প্রকৃত অপরধীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জীবন-বিনাশী এই সব ঘৃণ্য হামলার ব্যাপারে ইতোমধ্যেই জনমনে গভীর সন্দেহ ও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।’

‘কারণ পরিপূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রহরায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জবরদস্তি করে শাসকগোষ্ঠী কিছু কিছু যানবাহন রাস্তায় নামাচ্ছে। সেই সব যানবাহনে কেমন করে ঘাতক বোমার নৃশংস হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে, তা এক জ্বলন্ত প্রশ্ন’ যোগ করেন ২০-দলীয় জোটনেত্রী।
তিনি দাবি করেন, এসব হামলার ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে আজ পর্যন্ত তেমন কাউকে হাতে নাতে ধরা সম্ভব হয়নি। কোথাও কোথাও বোমা, গুলি ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ শাসক দলের চেলা-চামুণ্ডরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাদেরকে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটছে।
‘অথচ ঘটনার পরপরই বিরোধী দল ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনরা একতরফা প্রচারণা শুরু করে দিচ্ছে। কোনো তদন্ত ও তথ্য প্রমাণ ছাড়াই আমিসহ বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে পুলিশ মামলা দায়ের করছে’ যোগ করেন খালেদা জিয়া।
তিনি বলেন, ‘আমি পরিষ্কার ভাষায় আবারো বলতে চাই- মানুষের জীবন নিয়ে অপরাজনীতি আমরা করি না। হত্যা ও লাশের রাজনীতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন হীন ও নৃশংস অপরাজনীতি আমরা কখনো করবো না।’
বিএনপি চেয়ারপারসন অভিযোগ করেন, এখন যারা ক্ষমতা আঁকড়ে আছে তারাই অতীতে আন্দোলনের নামে যাত্রীবাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে ডজন ডজন মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে। লগি-বৈঠার তাণ্ডবে মানুষ হত্যা করে লাশের ওপর নৃত্য করেছে। একটার বদলে দশটা লাশ ফেলার প্রকাশ্য নির্দেশ দিয়েছে।

এসএসসি পরীক্ষা ৩ মাস পর্যন্ত পেছাতে বাধ্য করেছে
খালেদা জিয়া বলেন, লাগাতার হরতালে এসএসসি পরীক্ষা ৩ মাস পর্যন্ত পেছাতে বাধ্য করেছে। পবিত্র রমজান মাসে পর্যন্ত হরতাল করেছে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মাথা ইট দিয়ে থেতলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, তারা তদানীন্তন বিডিআর-এর পানি সরবরাহের লাইন কেটে দিয়েছে। এখনকার নৃশংস ঘটনাবলীও তাদের অতীত কার্যকলাপের সঙ্গেই মিলে যায়। দেশবাসী মনে করে, আন্দোলন দমন ও বিরোধী দলের ওপর জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা আরো বাড়াবার উদ্দেশ্যে শাসকদলই সুপরিকল্পিতভাবে এইসব সন্ত্রাসী ও নাশকতামূলক হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে।

শোক কাটিয়ে উঠার আগেই নিষ্ঠুর আচরণ
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমার কণিষ্ঠপুত্রের আকস্মিক অকাল মৃত্যুতে আমি মানসিকভাবে এক চরম শোকাবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। এই বিপর্যয়ের ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই আমার সঙ্গে কী ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে তা-ও সকলেই দেখছেন।’
তিনি বলেন, ‘সুপরিকল্পিতভাবে সর্বমুখী চাপ ও অনিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করে তারা আমাকে জনগণ ও নেতাকর্মী থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট। কিন্তু আমি সকলকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, কোনো অনৈতিক চাপ বা ভীতির মুখে আমি নত হবো না, ইনশা’আল্লাহ্‌। যে-কোনো পরিস্থিতি বা পরিণতির জন্য আমি তৈরি আছি।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী শাসকদের একদলীয় ধাঁচের স্বৈরশাসন কায়েমের অপতৎপরতার কারণে অতীতে দেশ জঙ্গিবাদের কবলে পড়েছিল। আমরা তা দমন করেছিলাম।’
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘আজ আবার তারা একই কায়দায় উদারনৈতিক রাজনীতির ধারাকে নিশ্চিহ্ন করতে যে চণ্ডনীতি অবলম্বন করছে তাতে আবারো সেই একই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।’
‘আমরা এই কঠিন বাস্তবতার দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার হবার জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি’ যোগ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে, আন্দোলন ভিন্ন পথ নেই
খালেদা জিয়া বলেন, ‘গত একটি বছর ধরে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ক্রমাগত আহ্বান জানিয়েছি। তারা কোনো কিছুতে কর্ণপাত করেনি।’

‘বরং সীমাহীন অত্যাচার উৎপীড়ন চালিয়ে গেছে। অবৈধভাবে করায়ত্ব করা রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হীন অভিপ্রায়ে তারা কোনো রকম সমঝোতায় রাজি হয়নি। এমনকি নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের কথা তারা স্বীকার করতেও রাহি নয়। তারা মনে করে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পথেই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে দেয়া সম্ভব’ যোগ করেন তিনি।
২০-দলীয় জোটনেত্রী বলেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আন্দোলন ছাড়া দেশবাসীর সামনে আর কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি। তাই ক্ষমতার জন্য নয়, গণতন্ত্র ও দেশবাসীর ভোটাধিকার এবং হৃত মৌলিক মানবিক অধিকার ফিরিয়ে আনতে এ আন্দোলন অভীষ্ট লক্ষে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতে থাকবে।’
এ আন্দোলনে সকলকে শরিক হতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। ন্যায়ের এ সংগ্রাম অবশ্যই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে ইনশা’আল্লাহ।’

আতিক/প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *