ক্যামব্রিয়ানের শিক্ষার্থী তানিয়া এখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

কবিতার প্রতিটি চরণের মতই ছন্দময় যার জীবন, তাঁর নাম তানিয়া ইসলাম। শিশু বয়সেই যার মেধার প্রতিফলন ঘটে মহল্লার মক্তব্যে। অজোপাড়া গাঁয়ের শতশত প্রতিভাবান শিশুদের মধ্যে অর্জন করেন সোনারমুকুট। সেই সাফল্যে পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছিলেন একটি কলম। কেউ কি জানত! এই কলমই বা হবে তাঁর জীবনের ভবিষ্যত অস্ত্র। সেদিন হয়তো জীবনের প্রথম পুরষ্কার পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়েছিলেন তানিয়া। তাইতো সেদিনের পুরষ্কার প্রাপ্ত কলমটি আজো আগলে রেখেছেন সযত্নে। সেদিনের সেই ছোট্ট তানিয়া বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ইন সায়েন্স এর প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। বাবা মো. মনিরুল ইসলাম। পেশায় তিনি একজন ব্যবসায়ী। মাতা পিয়ারা বেগম, যিনি সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন সংসারের কর্মযজ্ঞ নিয়ে অর্থাৎ যাকে বলে গৃহিনী।

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মাছপাড়া গ্রামে বেড়ে ওঠা তানিয়ার। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট তানিয়া। এই মেধাবীর অন্য আরেকটি নাম রয়েছে, তবে নামটি সবার প্রচলিত মুখে নয়, পরিবারের সদস্যরা আদর করে নামটি দিয়েছেন তানু। বড্ড বেশি অভিমানী মেয়েটি। ভাই-বোনদের সঙ্গে ঠুনকো ঝগড়া হলেই চুপটি করে, ঘরের কোণে বসে থাকার স্বভাবসূলভ মেয়েটি আজ মানুষ গড়ার কারিগর। যার ইচ্ছার কাছে পরিবারের সদস্যরা হার মানে অকপটে। আর সেই মেয়েটি আজ অন্যদের ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন, হচ্ছেন স্বপ্নময়ী মানুষগুলোর স্বপ্নপূরণের একজন সহকর্মী। এমনই একটি মহান পেশায় তিনি নিয়োজিত যার নাম শিক্ষকতা। যার বর্ণনা শুরু হয় তবে শেষ হবার নয়।
অতি সাধারণ ভোজন প্রিয় তানুর প্রিয় খাবার আর অন্য দশজন সাধারণ মানুষের মতই। আলু ভর্তা, ডাউল আর ভাতই তার প্রিয়। অন্য কিছু যেনো ভালোই লাগেনা। স্কুলের মাঠে সহপাঠীদের সাথে দলবেঁধে খেলা করার আনন্দই যেন অন্য রকম। তাইতো বিজড়িত স্মৃতিগুলো এখনো মনে পড়ে তাঁর, যা কখনো হাসায় আবার কাঁদায়। এভাবেই পটুয়াখালীর সোনামউদ্দিন মৃধা হাইস্কুল হতে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়া। বাবা মায়ের স্বপ্ন মেয়ে পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে। দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে। তাইতো বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ২০০৬ সালে পাড়ি জমালেন ঢাকায়। ভর্তি হলেন এমনই এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যার সুনাম দেশ ছাড়িয়ে তখন বহিঃবিশ্বে। অতপর বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্যামব্রিয়ান কলেজে। উল্লেখ্য, সেবারই প্রথম ক্যামব্রিয়ান কলেজের বিজ্ঞান শাখার যাত্রা শুরু হয়।

পরিবারের সবাইকে ছেড়ে শুরু হয় তানুর হোস্টেল জীবন। দিনে-রাতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রায় ১৮ ঘন্টা পড়েই থাকতেন বই নিয়ে। হোস্টেলে বন্ধু হিসেবে খুঁজে নিলেন বইকে। এক পর্যায়ে বই পোকা বলে সবাই তাকে ডাকতে শুরু করলেন। তবু তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি বরণ তাতে খুঁজে পেয়েছিলেন বড় হওয়ার প্রেরণা।

এমনই একটি ঘটনা বললেন তানিয়া, আমি তখন ক্যামব্রিয়ান কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। কেমিস্ট্রিতে সিলেবাসের বাহির হতে পরীক্ষা নেওয়া হলো। সবাই মোটামুটি পাস করলেও আমি এপ্লাস পেয়েছিলাম। তখন কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট এর প্রধান মাহবুব হাসান লিংকন স্যার বলেন, তুমি পড়ালেখা শেষ করো আমি তোমাকে ক্যামব্রিয়ানে কাজ করার সুযোগ করে দেব। যে কথা সেই কাজ, পরবর্তীতে আমার সুযোগ হয়েছিলো ক্যামব্রিয়ানে কাজ করার।

এবার আসি অপর প্রসঙ্গে, এইচএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে ইতি ঘটল হোস্টেল জীবনের। কিন্তু ফলাফল কি? এবারো ধরে রাখলেন কাঙ্খিত ফলাফল জিপিএ ৫। তাঁরপর কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিএসসি করেন পটুয়াখালীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ করেন। ফলাফল বরাবরেই মতোই প্রথম ক্যাটাগরিতে স্থান করে নেওয়া। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরষ্কারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কবিতা আবৃত্তি,নাচ, উপস্থিত বক্তৃতা ও ব্যাডমিন্টন এ প্রতিবছরই ১ম হয়ে অর্জন করেছেন একাধিক

পুরষ্কার। ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ায় পেয়েছিলেন অঞ্চল ভিত্তিক মেধা পরুষ্কার। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়ায় থানা ভিত্তিক পুরষ্কার, এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়ায় ক্যামব্রিয়ান কলেজ হতে গোল্ড মেডেল পুরষ্কার। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখে অর্জন করেছেন ইউজিসি পুরষ্কার এবং দু-বার ডিন’স এ্যাওয়ার্ড পুরষ্কার।

প্রতিভাবান শব্দটি বরাবরই যেন ভিন্নরূপী। কেননা যারা মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁরা প্রতিটি ক্ষেত্রে বহুদর্শী। তাঁদের পদাঙ্কের পরতে পরতে সফলতা। ব্যর্থতা নামক শব্দটি তাঁদের কাছে বড়ই দূর্বিষহ। তানিয়াও এমনই একজন প্রতিভাবান যিনি ব্যর্থতাকে নয় সফলতাকেই বন্ধু মনে করেন । তাইতো তিনি বেঁছে নিয়েছেন শিক্ষকতার মত মহান পেশাকে। যেখানে রয়েছে শতশত ফুলের বাগান। যাদের সংস্পর্শে হৃদয় জুড়ে যায়। যেখানে প্রতিনিয়ত তিনি সিক্ত হন প্রেম-ভালোবাসা আর সহমর্মিতায়। তাইতো আজো বারণবার তাঁর মনে পড়ে জীবনের প্রথম পুরষ্কার পাওয়া কলমটির কথা।

হয়তো তখন এই কলম সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিলো আতিশেয়। কিন্তু আজ এই কলমের মূল্য তাঁর কাছে অনেক। এখন প্রতিনিয়ত যে কলম তাঁর জ্ঞান প্রদানের বাহন হিসেবে কাজ করে। জীবনের প্রথম যে পুরষ্কারে তিনি সিক্ত হয়েছিলেন এখন সেই পুরষ্কার মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে তিনি বিলিয়ে থাকেন।

১৬ thoughts on “ক্যামব্রিয়ানের শিক্ষার্থী তানিয়া এখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *