পুত্র শোকে কাতর। মামলায় ভারাক্রান্ত। সাথে গ্রেফতারের হুমকি। অবরুদ্ধ কাটালেন ১৫দিন। এখন কৃত্রিম আঁধারে নিমজ্জিত। অভুক্ত রাত কাটছে বিনিদ্র। খাবার পানির বাসনও কাছে যাচ্ছে না। সব ধরনের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন। সব মিলিয়ে প্রায় ‘নির্বাসিত’ অবস্থা। তবুও অনড়, অটল, অবিচল এবং প্রস্তুত শোকাতুর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
বিএনপি নেতাকর্মী, ভিন্ন মেরুর রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের সাথে আলাপকালে বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ করে এমনভাবেই প্রকাশ করেছেন।
শুক্রবার রাত থেকে শনিবার পর্যন্ত। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ডিশ, ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন। এদিকে গতকাল দুপুরে মাদারীপুরে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খান হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, শুধু বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগই বন্ধ নয়, প্রয়োজনে ওই কার্যালয় ঘেরাও করে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হবে। তিনি বলেন, যে সকল বিএনপি নেতাকর্মীরা তার (খালেদা জিয়া) জন্য খাবার নিয়ে যাবে, ঘেরাওকারীরা সেই খাবার ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা ভাগ করে খাবে। ঘোষণার ৫ ঘণ্টার মাথায় সন্ধ্যায় ওই কার্যালয়ে পানি রাখার বাসনটিও (খালি ড্রাম) প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
এর আগে শুক্রবার বিকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে তিনিই গুলশান কার্যালয়ের গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন করার হুঁশিয়ারি দেন। ঘোষণার মাত্র ১২ ঘণ্টার মধ্যেই রাত পৌন ৩টায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। গতকাল সকালে ইন্টানেট, ডিস, টেলিফান সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি সব ধরনের মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে অত্যাধুনিক জ্যামার বসানো হয়েছে।
এদিকে সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রী ও নেতারা বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেফতার দাবি করেছেন। এই দাবিতে সংসদ থেকে ওয়াক আউটও করেছেন দুই এমপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, তাকে (খালেদা জিয়া) আইনের আওতায় আনাটাই যুক্তিযুক্ত।
৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ ঘোষণা ও কর্মসূচি পালনের দুদিন আগে থেকেই ১৫দিন পর্যন্ত অবরুদ্ধ। অবশ্য পরে অবস্থান করছেন। তাকে লক্ষ্য করে আদালত নিষিদ্ধ পিপার স্প্রে ছোড়া হয়েছে। অসুস্থ ছিলেন কয়েকদিন। সুস্থ হতে না হতেই সামনে ছোট ছেলের লাশ। নির্বাক থাকলেও শুনতে হয়েছে বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে পেট্রোল বোমা হামলার হুকুমের আসামি তিনি।
ছেলের কুলখানির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরইমধ্যে তার কার্যালয়ে বিদ্যুৎ, স্যাটেলাইট কানেকশন, ফোন-ফ্যাক্স লাইন বিচ্ছিন্ন। এ ঘটনায় খালেদা জিয়া নিজেই হতভম্ব, স্তব্ধ, ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এর প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সরকার। আমি স্তম্ভিত। এটা মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বয়স এখন একাত্তর চলে। এই বয়সে সরকারের কোন হুমকিই তাকে কাবু করার ক্ষমতা রাখছে না। তাকে সেনানিবাসের ৪০ বছরের বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়িটি ভাড়া নিয়েছেন সেখানেও যেতে পারছেন না। মনে হচ্ছে সরকার তাকে নির্বাসনে দিয়েছে।
এম কে আনোয়ার আরো বলেন, তার সাথে আমি যখন সাক্ষাৎ করেছিলাম তখন তিনি বলেছেন, আমার হারাবার কিছুই নেই। জালিম সরকারের নির্যাতন সারা দেশের মানুষ সহ্য করছে আমি তাদের সাথে শরিক হয়েছি মাত্র।
এদিকে বড় ছেলের স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমান তার স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছেন, ‘একজন মাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- সন্তান নাকি দেশ? তিনি উত্তরে বলেছিলেন- দেশ। এরপর অমানুষিক নির্যাতন নেমে এলো তার দুই সন্তানের ওপর। এক সন্তানের পায়ের হাড়গুলো ভেঙে দেয়া হলো, আরেক সন্তানকে ইলেকট্রিকের সাহার্যে ব্রেন ড্যামেজ করে দেয়া হলো। এরপর আবার সেই মাকে জিজ্ঞেস করা হলো- আপনার কাছে সন্তান বড় নাকি দেশ? উনি কেঁদেছেন। চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই বলেছেন- দেশ, এই দেশ আমার মা এই দেশ আমার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বপ্ন আমি আমার মায়ের কাছেই থাকব আমার স্বামীর স্বপ্নের দেশেই থাকব। আমি আমার দুই সন্তানকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়েছি। আমি বেঁচে থাকব আমার ১৬ কোটি সন্তানের মাঝে।’
গতকাল এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহম্মেদ বলেছেন, জনসভায় ঘোষণা দিয়ে গভীর রাতে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। ইন্টারনেট, ব্রডব্যান্ড ও ক্যাবল লাইনসহ সকল বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। সরকারি দল ঘোষণা দিয়েছে পানি, গ্যাস ও খাবার সরবরাহও বন্ধ করে দেবে। সভ্য দুনিয়ার ইতিহাসে এরকম ঘৃণিত ও জঘন্য নজির কোথাও নেই। অবিলম্বে বিদ্যুৎ সংযোগসহ সকল যোগাযোগ মাধ্যম পুনঃস্থাপনের ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান তিনি। অন্যথায় উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতির জন্য সরকার দায়ী থাকবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অনুধাবন করে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবেদিন ফারুক বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনকে জনবিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যই সরকার পরিকবল্পিতভাবে এসব করছে। এর আগেও ২০০৬ সালে তারা বঙ্গভবনে অবস্থানরত তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে অক্সিজেন বন্ধ করে দেবার মতো হুমকিও দিয়েছিল। এটা আওয়ামী লীগের নোংরা রাজনীতির অংশ। কিন্তু তাতে বিচলিত নন বেগম খালেদা জিয়া। তার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলেও আরো অনেক নেতাই আছেন যারা নির্দেশনা দেবেন।
রাষ্ট্র বিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শেষ সময়টা বিশেষ করে গত ১০ বছর করুণ দিন যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল তার এক লেখায় খালেদা জিয়াকে ধৈর্যশীল, বিচক্ষণ, প্রজ্ঞাবানদের অন্যতম বলে আখ্যা দিয়েছেন। ’৯০-এর আন্দোলনে তিনি যেমন আপসহীন উপাধি পেয়েছেন, আগামী দিনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আরেক উপাধি পাবার যোগ্যতা রাখেন।
এদিকে গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার দিন-রাত অতিবাহিত করার বর্ণনা দিয়ে তার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল বলেছেন, গতকাল (শুক্রবার) রাতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পর বেগম জিয়া কিশোরী দুই নাতনিকে নিয়ে বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন। ভেতরের সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এমনকি ফ্যাক্স কাজ করছে না।
আতিক / প্রবাস