আসিফ নজরুল
আরাফাত রহমান মৃত্যুবরণ করেছেন আকস্মিকভাবে এবং অকালে। মৃত্যুবরণের আগে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন তাঁর অনুপস্থিতিতে। তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছিলেন। আদালত থেকে অনুমতি নিয়েই হয়তো তিনি বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি এক-এগারোর পর আর দেশেই ফেরেননি। দেশে ফেরা তিনি নিরাপদ মনে করেননি। মনে করার কারণ হয়তো ছিল না। জিয়া পরিবারকে হয়রানি, হেয় ও কালিমালিপ্ত করার যে নিরন্তর নিষ্ঠা আমরা সরকারের মধ্যে লক্ষ করি, তাতে এই পরিবারের কেউ দেশে ফেরা নিরাপদ বোধ না করলে তা অযৌক্তিক বলা যাবে না।
আরাফাত রহমানের দুর্ভাগ্য তিনি জীবিতাবস্থায় দেশে ফেরার সুযোগই পাবেন না আর। পাবেন না আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও। ২০১৪ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির বিজয়ী হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা থাকত। তখন তিনি নিশ্চয়ই দেশে ফিরে আসতেন। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে দেশে ফিরলে নিশ্চয়ই তাঁর আর কোনো সমস্যা হতো না। বাংলাদেশের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করা হতো। তাঁদের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা ও হয়রানিমূলকভাবে মামলা করা হয়েছিল, সেটাও প্রতিষ্ঠিত করা হতো রাষ্ট্রীয়ভাবে। আরাফাত রহমান রাজনীতিতে না এলেও প্রবল ক্ষমতাবান থাকতেন। হয়তো তাঁর ছবি ছাপিয়ে জিয়া সৈনিকদের জয়গানে ছেয়ে যেত ঢাকার আকাশ, দেয়াল আর দিগন্ত।
মৃত্যু তাঁকে জীবনের যন্ত্রণা আর আনন্দের দোলাচল থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু শোকবিহ্বল করেছে তাঁর মা, ভাই, স্ত্রী-কন্যাদের। তিনি বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে। তাঁর মৃত্যু দেশে খালেদা জিয়ার অসংখ্য সমর্থককে বেদনাহত করেছে মূলত এ কারণেই। পরিচিত যেকোনো মানুষের পরিবারের কেউ মারা গেলে আমরা শোকাহত হই। সেটি মৃত্যুবরণ করা মানুষের জন্য যেমন, তেমনি তাঁর পরিবারের জন্যও। খালেদা জিয়ার প্রতি আমাদের সবার সমবেদনা সে জন্যই।
মৃত্যু এই জীবনের বহু হিসাব ঘুচিয়ে দেয়। আরাফাত রহমানের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের কাছে অনেকের ছুটে যাওয়া, সমব্যথী হওয়া স্বাভাবিক। অনেকে তা হয়েছেনও। কিন্তু আশ্চর্য এক ঘটনায় এ দিন অনেক মানুষ সমবেদনা প্রকাশ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও। তিনি পুত্রশোকে কাতর খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ফটক না খোলার জন্য তিনি রাস্তা থেকে ফিরে গেছেন। আরাফাত রহমানের মৃত্যু আর খালেদা জিয়ার পুত্রশোকের চেয়ে এটিই বড় খবর হয়েছে।
এখন কারও মনে হতে পারে খালেদা বা হাসিনার মতো মানুষেরা আসলে খুব দুর্ভাগা। শেখ হাসিনা তাঁর বাবার পরিবারের নির্মম হত্যাযজ্ঞকালে সান্ত্বনার জায়গাটুকুও খুঁজে পাননি কোথাও। তাঁর বাবার হত্যাযজ্ঞ যাঁরা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেনি, এর প্রেক্ষাপট রচনায় যাঁরা অংশ নিয়েছে, তাঁদের অনেককে সরকারে নিয়ে কাটাতে হয় তাঁর দিনরাত।
খালেদা জিয়াও অকালে হারিয়েছিলেন তাঁর স্বামীকে। তিনি তারপর যথেষ্ট পরিমাণ শোকাহত ছিলেন কি না কিংবা কেমন ছিল তাঁর দাম্পত্য-জীবন এই নিষ্ঠুর আলোচনা তাঁকে শুনতে হয় আজও। এখন তিনি সবচেয়ে দুঃসহ অবস্থায় হারিয়েছেন তাঁর ছোট ছেলেকে। আরাফাতকে তিনি দেখতে পারেননি বছরের পর বছর, দীর্ঘ অসুস্থতাকালে একবারও তাঁর সেবা করতে পারেননি, গঞ্জনা আর লাঞ্ছনা নিয়ে মারা যাওয়া ছেলের জন্য কিছুই করার সুযোগ পাননি। সবচেয়ে যা করুণ, পুত্রশোকের হাহাকারের দিনটিতেই তিনি ‘রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বা যথেষ্ট শিষ্টাচারের’ পরিচয় দিতে পারেননি বলে সমালোচিত হচ্ছেন অনেকের কাছে।
তাঁদের এই দুর্ভাগ্য থামবে কবে?
২.
আরাফাত রহমানকে কোনো দিন দেখিনি আমি, কোনো দিন তাঁর মুখের একটি কথা শোনা হয়নি। দেখা বা শোনার কথাও না। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, পাবলিক ফোরামে কোনো দিন কথা বলেননি। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হয়ে করুণ এক জীবন যাপন করে গেছেন। শৈশবে বাবাকে হারিয়েছেন, কৈশোরে তাঁর মাকেও ব্যস্ত থাকতে হয়েছে রাজনীতি নিয়ে, পরিণত বয়সে অনেকটা সময় তিনি বিদেশে কাটিয়েছেন নির্বাসিত মানুষের মতো। যদি তাঁর স্বাভাবিক জীবন থাকত, তবু তাঁর মৃত্যু অসহনীয়ই হতো তাঁর পরিবারের কাছে। মা হিসেবে এই মৃত্যু খালেদা জিয়ার জন্য এখন আরও দুঃসহ বেদনার।
শেখ হাসিনাও একজন মা। হতে পারে তিনি সত্যিই সমব্যথী হয়ে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বাসায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি বহু মানুষ বিশ্বাস করে না তা। পত্রিকা আর সামাজিক গণমাধ্যমের ওয়েবপেজে এ নানা মানুষের মতামত অনুসারে: শেখ হাসিনা নিজে বিভিন্ন সময় জিয়া পরিবারের প্রতি অবমাননাকর, নিষ্ঠুর এমনকি অশোভন মন্তব্য করেছেন, তাঁর শাসনামলে খালেদা জিয়াকে অমানবিকভাবে তাঁর বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছে, নানাভাবে অপমানিত করা হয়েছে, সপ্তাহ খানেকের বেশি সময় তাঁর সরকার কার্যত বন্দী করে রেখেছিল খালেদা জিয়াকে, মূলত তাঁর সরকারের নিপীড়নের আশঙ্কায় দেশে ফিরতে পারেননি আরাফাত রহমান। বহু মানুষ হয়েতা তাই মন্তব্য করেছেন যে শেখ হাসিনা ‘রাজনৈতিক নাটক’ করার জন্য বা ‘রাজনৈতিক সুবিধা’ লাভের জন্যই খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে গেছেন।
অনেকে আবার সমালোচনা করেছেন খালেদা জিয়ার কার্যালয় না খোলার। তাঁদের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রী সেখানে গিয়ে বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে, বিএনপির পক্ষ থেকে অশোভন ও শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণ করা হয়েছে, খালেদা জিয়াকে সত্যিই ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলেও অন্তত প্রধানমন্ত্রীকে দরজা খুলে ভেতরে বসার আহ্বান জানানো যেত।
কেউ কেউ বলছেন, দরজা না খোলা অভদ্রতা; কেউ কেউ বলছেন, দরজা না খোলার জন্য তাৎক্ষণিক সমালোচনা অভদ্রতা; কেউ বলছেন, খালেদা জিয়ার কার্যালয় থেকে তিনি ঘুমিয়ে আছেন বলার পরও প্রধানমন্ত্রীর যাওয়া ঠিক হয়নি; কেউ কেউ বলেছেন, এটাই বরং স্বাভাবিক সৌজন্য।
দুই নেত্রীর সম্পর্ক এমনই বিভক্ত করেছে দেশকে। কোনো মৃত্যু আর কোনো শোকও পারে না একে প্রশমিত করতে।
৩.
আমি ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করেছি, আমার সন্তান যাঁর ভয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে বিদেশে, আমার পরিবার প্রতিনিয়ত অপবাদ আর গঞ্জনার শিকার হচ্ছে যাঁর কাছ থেকে, আমাকে বাড়ি থেকে উৎখাত করেছেন যিনি, আমার ন্যায্য প্রাপ্য কেড়ে নেওয়ার পর উল্টো আমাকে জেলে ভরতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন যিনি, আমি তাঁকে কী ভাবব? প্রতিপক্ষ নাকি শত্রু? আমি নিশ্চয়ই শত্রুই ভাবব। শত্রু যদি আমার পুত্রশোকে হাহাকার করার সময় আসেন আমার বাসায়, তাঁর সঙ্গে দেখা করার মানসিক অবস্থা থাকবে আমার? থাকবে না হয়তো। কিন্তু আমি সম্ভবত তিনি আসবেন জানলে দরজা খুলে বসতে দিতাম তাঁকে।
তবে আমি সৌভাগ্যবান এমন একজন প্রতিপক্ষ কোনো দিন ছিল না আমার, নেইও। আমার চেনাজানা কোনো মানুষের জীবনেও নেই এমন শত্রু। আমার মনে প্রশ্ন জাগে: মাননীয় দুই নেত্রী, তাহলে কেমন করে এমন শত্রুতা হয় আপনাদের?
১৫ আগস্ট জন্মদিন উদ্যাপন আর ২১ আগস্টের পৈশাচিক হামলার পর শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই শত্রুই ভাবেন খালেদাকে। গত ছয় বছরের নিরন্তর নিপীড়নের পর খালেদা জিয়াও নিশ্চয়ই তা-ই ভাবেন শেখ হাসিনাকে। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার বাসায় ঢুকতে পারেননি খালেদা। ২৪ জানুয়ারিতে খালেদার বাসায় ঢুকতে পারেননি শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার স্বামীর মৃত্যুর পর অবশ্য খালেদা যেতে পেরেছিলেন হাসিনার বাসায়। ২৪ জানুয়ারির পর তিনিও হয়তো আর ঢুকতে পারবেন না হাসিনার বাসায়।
এটি যদি হতো সাধারণ দুজন মানুষের শত্রুতা, আমরা তাতে বিচলিত হতাম না। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে এই তিক্ততা বিভক্ত করেছে সারা দেশকে। এই তিক্ততা নিঃশেষ করে দিচ্ছে এই দেশের সম্ভাবনাকে। এর শেষ কোথাও কি আছে? নেই সম্ভবত।
পেট্রলবোমা আর ক্রসফায়ারের তাণ্ডব, মানুষের আহাজারি, বাংলাদেশের সর্বনাশ—কিছুই একসঙ্গে করতে পারেনি দুই নেত্রীকে। সন্তানের মৃত্যু পারেনি ঘোচাতে তাঁদের দূরত্ব। আমার আশঙ্কা হচ্ছে নিজেদের মৃত্যুর পরও ঘুচবে না দুই নেত্রীর দূরত্ব। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি আমার এই আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক তাঁদের জীবনকালেই।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।