জিয়া পরিবার কি আসলেই এই দেশের শত্রু !?

[লেখাটি লিখেছে জনপ্রিয় মাইক্রোব্লগার মুন্না আহমেদ প্রবাসনিউজের পাঠকদের জন্য]

হেড লাইন দেখে কি চমকে উঠলেন নাকি খুশি হয়ে লেখাটি পড়তে বসলেন ? তাহলে চলুন দেখে নেই জিয়া পরিবারের ইতিহাস , এই পরিবারটি কি কি খারাপ কাজ করে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম লিখিয়ে রেখেছে।

জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাগবাড়ী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন এবং তারপর ১৯৫৩ সালে করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। একই বছর তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে জিয়াউর রহমানের সাথে খালেদা জিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের প্রথম দশটি বছর একজন সেনা কর্মকর্তার ক্যারিয়ারের স্বাভাবিক টানাপোড়নের মধ্যে কেটে গেছে। এরমাঝে ১৯৬৫ সালে (পাক ভারত যুদ্ধের সময়) যুদ্ধোরত সৈনিক পরিবারের টেনশনের স্বাদ পুরোমাত্রায় গ্রহন করেছেন। ১৯৬৫ সালে খালেদা জিয়া স্বামীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান) যান। ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত করাচিতে স্বামীর সাথে ছিলেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন জয়দেবপুর থাকার পর চট্টগ্রামে স্বামীর পোস্টিং হলে তার সঙ্গে সেখানে এবং চট্টগ্রামের ষোলশহর একালায় বসবাস করেন। আর্মি অফিসারগণ যে সময়ে পরিবার নিয়ে একটু স্থির হন তখনই এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নিজের পরিবারের নিরাপত্তার কথা সামান্য চিন্তা না করে ঐ মুহুর্তে অত্যন্ত জরুরী স্বাধীনতার ঘোষণাটি দিয়ে বসেন। এর ফলে পাক বাহিনীর আক্রোশটি নিজের ও পরিবারের উপর নিয়ে আসেন। এর সকল ধকল সইতে হয়েছে এই ইয়ং পরিবারটিকে।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত থাকেন। ২ জুলাই সিদ্ধেশরীতে জনাব এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে পাক সেনারা তাকে দুই ছেলে সহ বন্দী করে। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি পান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সবাই ভেবেছিলো শান্তিতে বসবাস করতে পারবে কিন্তু না, সবার সব আশা ভেঙে দিল মুজিব সরকার, দেশে রক্ষিবাহিনী তৈরি হলো, অনাহারে মারা গেল লক্ষ লক্ষ মানুষ, দিন দিন যখন অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চললো তখন কিছু সেনা কর্মকার্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট শেখ মুজিবর রহমানের হত্যা করলো। পরে খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ বছরের ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন ঢাকা ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের সহায়তায় বীর উত্তম মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ এক ব্যার্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। এর ফলে ৬ই নভেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হন। এর পর জিয়াউর রহমানকে চীফ-অফ-আর্মি স্টাফ হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসভবনে গৃহবন্দী করে রাখা হয় যা সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তার কারনে অত্যন্ত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুদ্ধ সেনা সদস্যরা বীর উত্তম কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের নেতৃত্বে ৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার আরেক পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় এবং ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সেনাসদস্যরা লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) নেতৃত্বে, জিয়াউর রহমানকে তাঁর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গৃহবন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে আসে।

এর পরে জিয়াউর রহমান ২১শে এপ্রিল বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন

“ I will make politics difficult for the politicians ”

১৯৭৮ সালের ৩রা জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এবং তারপরে সে দেশের জন্য কি করেছেন সেটা সবাই জানেন, তার জনপ্রিয়তা কি ছিলো সেটা এখন না বললেও সবাই বুঝবেন, তাকে আধুনিক বাংলার রূপকার বলা হতো। তিনি এই দেশটাকে মাত্র কয়েক বছরে পুরো পাল্টে দিলেন। অতঃপর ৩০শে মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের নেতৃত্বে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন।

৩০ মে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর, এরশাদের রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ হয়ে পড়ে। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।

১৯৮৩ সালের বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। বেগম জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনের দলের সাথে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচী শুরু করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙ্গে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখান করে। ১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া “এরশাদ হটাও” এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙ্গে দেন। পুনরায় শুরু হয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর একটানা নিরলস ও আপোসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।

এই সব কিছুই কিন্তু এই দেশের জনগনের জন্য , এই জিয়া পরিবারের ব্যাক্তি সার্থে কোন কাজ করে নি। এই জিয়া পরিবার নিজে কোন ফায়দা হাসিল করেনি। তার বদলে এই দেশ জিয়া পরিবারকে কি দিয়েছে দেখে , জিয়া পরিবারের নিজস্ব কোন বাস ভবন নেই। বেগম খালেদা জিয়া কয়েকবার প্রধান মন্ত্রী হবার পরেও ক্যান্টনমেন্ট বাসাতে থাকতেন কিন্তু শেখ হাসিনা তার থেকেও সেটাও কেড়ে নিল। যে বাড়িটিতে তিনি ২৮ বছর থেকেছেন সেই বাড়িটি থেকে তাকে এক কাপড়ে বের করে দেওয়া হয়। ১৩ নভেম্বর ২০১০ সালে তাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপরেও সে প্রতিবাদ করেনি কারন সে দেশকে ভালোবাসে।

এতো কিছুর পরেও কিন্তু থেমে থাকেনি জিয়া পরিবার দেশের আজ ক্রান্তি লগ্নে এই জিয়া পরিবারই ছুটে এসেছে , বাংলাদেশে আবারো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এই জিয়া পরিবারই ভুমিকা রাখছে। ১/১১ -এর চক্রান্তর জন্য তার দুই ছেলেম মুখ দেখতে পারেনি কতো দিন, সে আজ অসহায় নারীর মতো একা একা জীবন যাপন করছে। সন্তানের মৃত্যুর সময়ও সে দেখতে পেলনা তাকে, সন্তানের লাশ সামনে রেখেও সে ভেবেছেন দেশের কথা।

বেগম খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- সন্তান নাকি দেশ ?
উনি বলেছিলেন- দেশ ! এরপর অকথ্য নির্যাতন নেমে এলো তার দু সন্তানের উপর। এক সন্তানের কটিদেশের কশেরুকা গুলো ভেঙে দেয়া হলো আর আরেক সন্তানকে ইলেকট্রিক শকে ব্রেন ড্যামেজ করে দেয়া হলো।
উনাকে আবারো জিজ্ঞেস করা হলো- সন্তান নাকি দেশ ?
উনি কেঁদেছেন। চোখের পানি ফেলতে ফেলতেই বলেছেন- দেশ। দেশ আমার মা। আমি মায়ের কাছেই থাকবো। আমার দু সন্তানকে আমি আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়েছি। আমি বেঁচে থাকবো আমার ষোলো কোটি সন্তানদের মাঝে ! ইনিই বেগম জিয়া। আজ উনার সেই দুসন্তানের একজন আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছেন। আমি জানি তবু তিনি বিচলিত নন। এই হলো বেগম খালেদা জিয়া, যে দেশের জন্য নিজের সন্তানদেরকেও উৎসর্গ করেছেন।

একবার চিন্তা করুন এই পরিবারটির সুখের সময় বলতে ছিলোই না, ছিলো সুধু দুঃখ। যেই পরিবারটি দেশের জন্য সব কিছু ত্যাগ করলো তাকে আপনার কি দিয়েছেন, কিছুই না শুধুই বদনাম দিয়েছেন, জিয়াউর রহমানকে পাকি দালাল বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিভিন্য ভাষায় গালাগালি দিয়েছে। তারপরেও এই পরিবারটি সহ্য করেছে সামান্য প্রতিবাদটুকু করেনি। কারন এই পরিবারটি কখনো চেতনা বিক্রি করে চলে না , এই দলটি মুক্তিযুদ্ধকে বিক্রি করে চলে না। বিএনপিই একমাত্র দল যার প্রতিষ্ঠাতা নিজেই মুক্তিযোদ্ধা।

কিন্তু এই পরিবারকে তিলে তিলে শেষ করার জন্যে পুরো রাষ্ট্র শক্তি এবং তার বিষাক্ত ও ইভিল মিডিয়া এই পরিবারের সদস্যদের পেছনে লেগেছে। আর তাকে পুরাপুরি মদদ দিচ্ছে একটি আধিপত্যবাদী শক্তি। কারন এই সিঙ্গেল পরিবারটি এখন জাতীয়তাবাদের শেষ ও একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে পড়েছে। আধিপত্যবাদের ক্রীড়নক অশুভ শকুনদের সকল ক্ষোভ ও ক্রোধের মূল টার্গেট আজ এই পরিবার। এই পরিবার শেষ হলে দেশকেও থেমে যেতে হবে , তাই বলছি সময় থাকতে সচেতন হন।

এখন প্রশ্ন রইলো এই জিয়া পরিবার দেশের ক্ষতি কি করেছে একটু বলুন ? শুধু দেশকে ভালোবাসার জন্য এই পরিবারটাকে কেন এতো অপবাদ দেওয়া হচ্ছে  ? তাহলে দেশকে ভালবাসা কি অপরাধ !?

শেষে কিছু কথা বলবো, আমি যে প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করি সে প্রজন্মকে। যে ছেলে নিজেকে বাপের চেয়ে বেশী জ্ঞানী মনে করে সে ছেলের পতন অনিবার্য। ইতিহাস আমরা দেখিনি, আমাদের পূর্বপুরুষরা দেখেছে। কাজেই ইতিহাস সম্পর্কে নিজেকে বেশী জ্ঞানী মনে করার কোন কারন নাই। তোমরা যারা ইতিহাস বারংবার এডিট করতে ভালবাসো, তাঁদের বলছি, ইতিহাস রচনা হয়েই আছে, সেটাকেই আগে জানো। টাইম মেশিনে করে পেছনে গিয়ে ইতিহাসকে এডিট করার চেষ্টা না করাটাই সবার জন্য ভাল, এটা ফেসবুক পোস্ট না যে তোমার মন মত না হলে এডিট করে নিবে।

তথ্যসূত্রঃ-
http://tinyurl.com/n34cxvt
http://tinyurl.com/lm68snq
http://tinyurl.com/kq6j2tx
http://tinyurl.com/ml6e6hg
http://tinyurl.com/kdtu3u9

______________________________________________________________________________

মুক্তকথা বিভাগে সকল লেখা/কথা একান্তই লেখকের নিজেস্ব এবং মুক্তকথা বিভাগে প্রকাশিত কোন লেখা প্রবাসনিউজ২৪ডটকম দায়ভার বহণ করে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *