পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ের জমিতে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবার জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে সরব হয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। তাৎপর্যপূর্ণভাবে কেন্দ্রের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে ওই একই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গেল ঢাকা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পরামর্শদাতা এইচটি ইমাম তার সদ্যসমাপ্ত নয়াদিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে বর্ধমান কাণ্ডে জামায়াত ও প্রতিবেশী রাজ্যের যোগাযোগের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। একই উদ্বেগ তিনি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছেও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মনে করছে ইমামের ওই আশঙ্কা অমূলক নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে আসা একটি রিপোর্টে ভারত বাংলাদেশের সন্ত্রাস-সংযোগ নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগজনক তথ্য এসেছে। খাগড়াগড় নিয়ে বাংলাদেশের ওই আশঙ্কা অবশ্য নতুন নয়। এর আগে একাধিকবার বাংলাদেশের মন্ত্রীরা ঢাকা থেকে বা নয়াদিল্লি এসে প্রশ্ন তুলেছেন। তথ্য জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারের কাছ থেকেও। এ ব্যাপারে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা করার আশ্বাসও দিয়েছিলেন তারা। ওই ঘটনার পরে তিন মাস অতিক্রান্ত। সম্প্রতি ভারত সফরে এসে এ ধরনের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে তার জন্য দুদেশের নিরাপত্তা সমন্বয়কে আরও অনেকটাই বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন হাসিনার পরামর্শদাতা ইমাম। পরে তিনি বলেছেন, ‘বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনাও সেটিতে কেন্দ্র করে জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও তাদের ভারতীয় সহযোগীদের গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টি আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ‘দুদেশের মধ্যে নিরাপত্তা সমন্বয় কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে ভারতকে সব রকম সাহায্য করতে বাংলাদেশ প্রস্তুত।’ শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের বিষয়েও যে ঢাকা আগ্রহী সে কথা ভারতীয় নেতৃত্বকে জানিয়েছেন ইমাম। তার কথায়, ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নের একটি বড় দিক রয়েছে যা কিনা নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। তা ভুলে গেলে চলবে না।’ বাংলাদেশকে যে এ মুহূর্তে হিংস্র মৌলবাদের শিকার হতে হচ্ছে, সেই মৌলবাদকে বিভিন্ন দেশের ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন প্রভাবিত করছে এমন প্রমাণ এসেছে বাংলাদেশের হাতে। সেই প্রভাব পরিধি বিস্তার করেছে বাংলাদেশসংলগ্ন আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বলেই মনে করছে কেন্দ্র। খাগড়াগড় কাণ্ডের পর পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তরপ্রদেশের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য জানতে চায় কেন্দ্র। রাজ্যের উত্তরে সন্তুষ্ট না হওযায় এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে বিএসএফের ওপর। কিন্তু দায়িত্ব যখন হাতে এসেছিল তখনও বোঝা যায়নি চিত্রটি এতটা গুরুতর। কিন্তু খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে অনুমোদনহীন সংখ্যালঘু ধর্ম প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেখে চমকে উঠেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অংশ ভারতবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর শিমুলিয়া ও লালগোলার একাধিক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম তদন্তে উঠে আসে। তদন্তে দেখা যায় ওই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেবল পুরুষেরাই নয়, নাশকতার প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন মহিলারাও। তারপরেই নড়েচেড়ে বসে কেন্দ্র। সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে থাকা বিএসএফকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে থাকা সংখ্যালঘু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্বন্ধে বিশদ খোঁজ নিতে বলা হয়। তদন্তে দেখা গেছে, আসাম থেকে পশ্চিমবঙ্গ- এ অংশে প্রায় ২০ হাজার সংখ্যালঘু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের এক-তৃতীয়াংশ হলো সরকারি অনুমোদনহীন। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অনুমোদনহীন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি বড় অংশের কার্যকলাপ সন্দেহজনক। এদের অধিকাংশ বিদেশ থেকে টাকা পেয়ে থাকে। স্থানীয় গ্রামবাসীই জানেন না তাদের গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কারা চালান বা সেখানে কারা পড়তে আসেন। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান খাগড়াগড় কাণ্ডের পর বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্রের মতে, সেগুলো যে ভারতবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। খাগড়াগড় কাণ্ডের পর ধরপাকড় শুরু হওয়ায় তাই তড়িঘড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই অবস্থা আসামেও। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর থেকে শুরু হয়ে মালদহ, মুর্শিদাবাদ হয়ে ওই জঙ্গি নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর চব্বিশ পরগণা পর্যন্ত। উল্টোদিকে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে অন্তত ৫০টি স্থানে জঙ্গি শিবির চালু ছিল বলে তদন্তে জানা গেছে। সীমান্তসংলগ্ন এলাকা চৌগাছা, জীবননগর, মেহেরপুর, ফুটিয়া, দেবগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কেশবপুর, বড়িশাপুর এলাকায় জঙ্গি শিবিরের হদিস জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। ওই শিবিরগুলোতে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ ও ভারতবিরোধী নাশকতায় উৎসাহ দিতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই ও লস্করের মতো পাক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো। তবে এখন খাগড়াগড় কাণ্ডের দুই তরফে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় শিবিরগুলোতে তৎপরতা কমে গেছে। কিছু শিবির বাংলাদেশ প্রশাসন নষ্ট করে দিয়েছে। কিছু শিবির বন্ধ হয়ে গেছে। আসাম-পশ্চিমবঙ্গ ছাড়িয়ে মৌলবাদী জাল যে বিহারেও ছড়িয়েছে তার প্রমাণও এসেছে গোয়েন্দাদের হাতে। প্রশ্ন উঠেছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভূমিকা নিয়েও। আসাম-পশ্চিমবঙ্গের মতো নেপাল লাগোয়া বিহার সীমান্তেও সেখানকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলেই মনে করছে কেন্দ্র। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওই এলাকাগুলোতে এমন কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে যাদের ভূমিকা যথেষ্ট সন্দেহজনক। ওইসব সংগঠনের জন্য সৌদি আরব, কুয়েতের মতো বেশ কিছু দেশ থেকে নিয়মিত টাকা আসছে। যা ব্যবহার হচ্ছে ভারতবিরোধী কাজে।
সুত্র-বাংলাদেশ প্রতিদিন