পৃথিবীতে ২০১৪ সালটি ছিল অত্যন্ত উষ্ণ। এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে এই বছরটির তাপমাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি। এটা বৈশ্বিক উষ্ণতা সম্পর্কে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
‘আমরা এখানে ভাজা হয়ে যাচ্ছি’ শিরোনামের একটি ভাস্কর্য। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির একটি সৈকত থেকে তোলা ছবিএনওএএর প্রতিবেদনের যথার্থতা যাচাই করে দেখেছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা)। তারাও একই উপসংহারে পৌঁছেছে।
এনওএএর প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থলভূমি ও সমুদ্রপৃষ্ঠে ২০১৪ সালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৮৮০ সালে রেকর্ড সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু হওয়ার পর সর্বোচ্চ।
২০১৪ সালজুড়ে গড় তাপমাত্রা ছিল বিংশ শতাব্দীর গড় তাপমাত্রার চেয়ে শূন্য দশমিক ৬৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এই ব্যবধানের হিসাবে গত বছরটি ২০০৫ ও ২০১০ সালকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর তুলনায় ওই দুই বছরের গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক শূন্য ৪ সেলসিয়াস পরিমাণ বেশি ছিল।
বিশ্বের যেসব অঞ্চলে গত বছর তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও আলাস্কার পশ্চিমাঞ্চল, দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যাঞ্চলের কিছু অংশ, অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের কিছু অংশ, উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা। আর নিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড শুধু যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের কিছু অংশে দেখা গেছে।
জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে মানুষই বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এনওএএর প্রতিবেদনে এটা স্পষ্ট হয়েছে। এ ধরনের জ্বালানির ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়ে। নাসার গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজের পরিচালক গ্যাভিন শ্মিডট বলেন, মানুষ জানতে চাইছে, কেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তথ্য-উপাত্তে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসই মূলত দায়ী।
ক্লাইমেট সেন্ট্রাল নামের একটি গবেষণা সংস্থা জানায়, বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ব্যাপারগুলো প্রতি ২ কোটি ৭০ লাখে একবার ঘটে। কিন্তু এর মধ্যে উষ্ণতম ১৫টি বছরের মধ্যে ১৩টিই ২০০০ সালের পর এসেছে। ধারাবাহিকভাবে না এসে এগুলো এলোমেলোভাবেও আসতে পারত। এই গ্রহের তাপমাত্রার ওপর মানুষের কর্মকাণ্ডের প্রভাবের কারণেই উষ্ণতম বছরগুলোর ধারাবাহিক আবির্ভাবের কারণ হতে পারে।
তাপমাত্রার রেকর্ডভুক্ত বছরগুলোর মধ্যে ২০১৪ সালই উষ্ণতম। ব্যাপারটা জেনে কেউ বিস্মিত হলেই সেটা বিস্ময়কর হবে—এমন মন্তব্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির। তিনি বলছেন, বিজ্ঞান তো দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেই চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববাসী কখন এবং কীভাবে এ ব্যাপারে সাড়া দেবে। কার্যকর সমাধানের লক্ষ্যে উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবসম্মত উদ্যোগই এখন একমাত্র অবলম্বন হতে পারে।
উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীদের সংগঠন ইউনিয়ন অব কনসার্নড সায়েন্টিস্টসের জ্যেষ্ঠ জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ব্রেন্ডা একুরজেল বলেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই রেকর্ড দীর্ঘ মেয়াদে বারবার ভাঙবে বলে আশা করা যায়।
এনওএএর প্রতিবেদনটির পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবিলায় জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবিদেরা। বিশ্বের সব দেশের সরকারকে এ ব্যাপারে মনোযোগী ও উদ্যোগী হতে হবে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের আহ্বান জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। চলতি বছরের ডিসেম্বরে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনেই বিষয়টি চূড়ান্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
গ্যাভিন শ্মিডট আরও বলেন, সাধারণ মানুষও দৈনন্দিন জীবনে কিছু অভ্যাস পাল্টে এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। উষ্ণতার জন্য দায়ী কার্বন নির্গমন কমাতে তারা ব্যক্তিগতভাবে তৎপর হয়ে উন্নততর ও পরিবেশবান্ধব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে। পাশাপাশি গাড়িচালনা কমিয়ে হাঁটা বা বাইসাইকেল চালনার পথ বেছে নিতে পারে।
সূত্র: এএফপি, রয়টার্স ও বিবিসি