লাগাতার হরতাল-অবরোধে রাজধানীর জীবনযাত্রা মোটামুটি স্বাভাবিক থাকলেও সারা দেশের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সড়কপথে যাত্রীদের যাতায়াত আর পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় রাস্তায় অবরোধ সমর্থকদের চোরাগোপ্তা হামলায় পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরও বেশি নাজুক।
পরিবহন মালিক ও চালকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অবরোধের পঞ্চম দিন থেকেই দূরপাল্লার বাস-কোচ ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই মোতাবেক পুলিশ প্রহরায় ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ, চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটে বেশ কিছু কোচ ও পণ্যবাহী ট্রাক চলাচলও শুরু হয়। কিন্তু স্থানে স্থানে হামলা-ভাঙচুর ও রংপুরের মিঠাপুকুরে পেট্রলবোমা ছুড়ে বাস জ্বালানোর ঘটনায় ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। এর পর থেকে সাধারণ যাত্রী এমনকি বাস-ট্রাকের চালক-হেলপাররা পর্যন্ত পুলিশ প্রহরায় যানবাহন চালানোতেও নিরাপদ বোধ করছেন না। ফলে ট্রেন আর লঞ্চনির্ভর হয়ে পড়েছে যাত্রীদের যাতায়াত।এদিকে গত কয়েক দিনে বিভিন্ন স্থানে রেল লাইনে নাশকতার ঘটনায় ট্রেন চলাচলের শিডিউল পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। একেকটি ট্রেন নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ১২-১৩ ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অনিশ্চিত এ ট্রেন যাত্রার মধ্যেও বিপাকে পড়া মানুষজন একস্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে সক্ষম হচ্ছেন। তবে লঞ্চ চলছে প্রায় স্বাভাবিকভাবেই। টানা ১১ দিন ধরেই সারা দেশ থেকে রাজধানী কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতকারী মানুষজনের দুর্ভোগের অন্ত নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম ও বাজার পরিস্থিতি সবচেয়ে বেহাল হয়ে পড়েছে। পরিবহনের অভাবে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ অচল হয়ে পড়ায় রাজধানীর বাজারে সব ধরনের পণ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে গেছে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে ক্ষেতের আইলে আইলে পড়ে আছে কৃষকের উৎপাদিত শস্যপণ্য। ক্রেতার অভাবে কোথাও কোথাও পানির দরে বিক্রিও করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ ঢাকায় সেসব পণ্য চড়া দামেও কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। রাজধানী ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে হরতাল-অবরোধেও দিব্যি গাড়ি চলাচল করছে। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় নগরীর বহু স্থানে রীতিমতো যানজটও বাঁধছে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর অভ্যন্তরীণ রুটেও নিয়মিত গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। কেবলমাত্র আন্তঃজেলা যোগাযোগ ও ঢাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত সড়ক-মহাসড়কে যানবাহন চলাচল করছে না। চরম ঝুঁকি নিয়ে কোনো কোনো গাড়ি যাত্রী বা পণ্য বোঝাই করে রওনা দিলেও পথে পথে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন রাখতেই বেশি সহিংসতা ছড়িয়েছে অবরোধকারী রাজনৈতিক দলগুলো। আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারা, বাস পুড়িয়ে দেওয়া, বোমা-ককটেল মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করার মূল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়ানো। রেল লাইনে নাশকতা সৃষ্টিসহ বাসে আগুন ধরানোর মধ্যে সাধারণ মানুষকে ঢাকামুখী না হওয়ার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হরতাল-অবরোধে রাজধানী ঢাকাকে অচল করতে পারলেই বিরোধী দলের আন্দোলন সফল হবে। এই ছকেই চলছে হামলা, ভাঙচুর, সহিংসতার অবরোধ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধের ১১তম দিনে গতকাল দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের জনজীবন স্বাভাবিক রয়েছে। শুধু বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে ঢাকাকে।ঢাকামুখী ৪০ পয়েন্ট বিপজ্জনক : হরতাল-অবরোধের মধ্যেও নিয়মিত পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলাচলকারী চালক-হেলপাররা জানিয়েছেন, ঢাকামুখী বিভিন্ন আন্তঃজেলা রুটের ৪০টি পয়েন্ট মারাত্মক বিপজ্জনক। এসব স্থানেই অবরোধকারীরা ওতপেতে থাকে, তারা যানবাহন দেখলেই হামলা চালায়। এর মধ্যে ঢাকা-উত্তরবঙ্গ রুটের ১৫টি পয়েন্ট, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৯টি, ঢাকা-সিলেট রুটে ৭টি, গোয়ালন্দ-খুলনা রুটের ৪টি, বরিশাল রুটের ৩টি ও ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে দুটি পয়েন্ট রয়েছে বলে দাবি করেন তারা। সংশ্লিষ্ট চালকরা জানান, পুলিশ পাহারায় এসব স্থান অতিক্রমকালেও অবরোধ সমর্থকরা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে থাকে। পুলিশ সাধারণত ব্যস্ততম বাসস্ট্যান্ডেই ডিউটিরত থাকে। কিন্তু বাসস্ট্যান্ড বা জনাকীর্ণ স্থানের কয়েকশ গজ এপাশে-ওপাশেই সংঘবদ্ধ হামলাকারীরা দল বেঁধে অপেক্ষমাণ থাকে। তাদের হামলা এড়িয়ে যানবাহন চালিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বলেও ভুক্তভোগী বাস-ট্রাকের চালক-হেলপাররা জানিয়েছেন।অবরোধে বিপাকে চাষি-ক্রেতা-বিক্রেতা : হরতাল ও অবরোধের কারণে পণ্য পরিবহনে সঙকট দেখা দেওয়ায় জেলায় জেলায় চাষি, ক্রেতা ও বিক্রেতারা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কবে নাগাদ এ অবস্থা স্বাভাবিক হবে আর সংকট দূর হবে তা নিয়ে কেউই কিছু ভাবতে পারছেন না। ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপি নেতৃত্বধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকে অবরোধ শুরু হয়েছে। তার আগে ৩ জানুয়ারি সরকারের অঘোষিত অবরোধে স্থবির হয়ে যায় যান চলাচল। এর পর থেকেই সৃষ্টি হয় অচলাবস্থার। সারা দেশে পণ্য পরিবহন আর মালামাল আনা-নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বেশি উৎপাদন হয় কৃষিপণ্য ও মাছ। এখানকার সবজি ও মাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের অন্যান্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পিয়াজ, মরিচ, আদা-রসুনসহ অন্যান্য পণ্য ওই জেলাগুলোতে যায়। আর এসব পণ্য আনা-নেওয়ার প্রধান রুট সড়কপথ। তবে লাগাতার অবরোধ আর হরতালের কারণে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও দু-একটি ট্রাক ঝুঁকি নিয়ে পণ্য পরিবহন করছে, তারাও ভাড়া নিচ্ছে দ্বিগুণ- তিনগুণ। পরিবহন সংকটের কারণে অনেক চাষি ক্ষেত থেকে উৎপাদিত পণ্য তুলতে চাচ্ছেন না। যারা তুলছেন তা দিনের পর দিন ক্ষেতের আইলে ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া মৎস্যচাষিরা ভরা মৌসুমেও কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ার শঙ্কায় পুকুর থেকে মাছই তুলছেন না। ঢাকার পাইকারি বাজারের আড়তদাররা জানিয়েছেন, এ সময় উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন শুধু শীতের সবজি নিয়েই ছয়-সাতশ ট্রাক ঢাকায় এসে পৌঁছাত। অথচ গত রাতে প্রায় আড়াই গুণ বেশি খরচে মাত্র আট ট্রাক সবজি এসে পৌঁছায়। ফলে বাজারে শাক-সবজিসহ কাঁচা মালামাল কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, যা ছিটেফোঁটা মিলছে সেগুলোর দাম থাকছে আকাশছোঁয়া। খুলনা থেকে পুলিশ পাহারায় কাঁচা মালামাল বোঝাই ট্রাক নিয়ে ঢাকায় পৌঁছানো ব্যবসায়ী আলম, হানিফ ও জাহাঙ্গীর জানান, মাঠে সবজির দাম খুবই কম। কিন্তু পরিবহন ভাড়া দেড়-দুই গুণ বেড়ে গেছে। ১০-১২ দিন আগেও খুলনা থেকে ঢাকাগামী ট্রাকের ভাড়া ছিল ২০ হাজার টাকা। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। তারপরও পথে পথে নানা শঙ্কার মধ্য দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। রাজশাহীর পবা এলাকা থেকে আগত ট্রাক চালকরা জানিয়েছেন, সেখানে হাটবাজারে আর কৃষকের ক্ষেতের আইলে বিপুল পরিমাণ সবজি, সিম, ফুলকপি নষ্ট হচ্ছে। সেখানকার বাজারে এসব কাঁচা তরিতরকারির দাম নেই বললেই চলে।
সুত্র-বাংলাদেশ প্রতিদিন