গনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের দাবী ও বাংলাদেশের চারিদিকে মৃত্যু

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর যে দলটি ক্ষমতা পায়, ক্ষমতা পাবার পরে সেই দলটি আর জনগনের প্রতিনিধি থাকেনা। প্রতিনিধি থেকে এরা রাজা হয়ে যায়। জনগন হয়ে যায় প্রজা। বাংলাদেশের প্রশাসনযন্ত্রটি ব্যবহৃত হয় সেই দলটির লোকজনের টাকা বানাবার মেশিন হিসাবে। ক্ষমতা, কোটি টাকা, রাজার হালে থেকে অভ্যস্ত হয়ে যাবার ফলে নিজেদের এরা বাংলাদেশের মালিক মনে করে। বাপ, মেয়ে, নাতির ছবি দিয়ে ব্যানার তৈরি করে। এই দেশ আমার বাপের, এই দেশ আমার বাপের সম্পত্তি। এই দেশের উত্তারাধিকারি আমার ছেলে। স্বামী, স্ত্রী ও পুত্রের ছবি দিয়ে ব্যানার তৈরি হয়। কারণ যারা অই দলে সুবিধা করতে পারেনি তারা বিরোধীদলে স্বামী, স্ত্রী ও পুত্রের ছবির নীচে এসে আশ্রয় নেয়।

বাংলাদেশের জনগন এখন প্রজা। রাজা যা বলে তা শুনতে হবে । রাজার বিরোধিতা করলেই মরতে হবে। রাজারা সব একদিকে তারপর মন্ত্রী তারপর পাইকপেয়াদা তারপর ভীত সন্ত্রস্থ জনগন। রাজা ও প্রজার মাঝখানে রাজা বদল করার জন্য জনগনের নাকের সামনে একটি শব্দ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় । তা হলো “গনতন্ত্র” ।

ভোট দিতে পারলে – গনতন্ত্র আছে।
ভোট দিতে না পারলে – গনতন্ত্র নাই।
ভোট দিয়ে জনগন যাকে রাজা বানাক সেটা কোন বিষয় না।
যতক্ষন রাজা বদল না হবে ততক্ষন এই “গনতন্ত্র” নামক মুলাটি প্রজা/জনগনের নাকের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হবে।

বাংলাদেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলের নেতাদের ব্যক্তিগত জীবনে যদি উঁকি দেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে ৯৯% নেতা চোর বা দুর্নীতিবাজ। বেশীর ভাগ নেতাই অতীতে কোন না কোনভাবে দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকতে দেখা গেছে। লুট, চুরি, বাটপারী, মিথ্যাচার করতে দেখা গেছে । জনগনের সম্পদ চুরি ও জনগনের তহবিল তছরুপ করতে দেখা গেছে। দেশের সম্পদ পাচার করতে দেখা গেছে, ব্যক্তিগত লাভের জন্য জনগনের রাজস্ব ব্যবহার করতে দেখা গেছে। যেহেতু জনগনকে এরা প্রজা মনে করে যেহেতু এরা নিজেদের রাজা মনে করে তাই জনগনের খাজনা রাজার আরাম আয়েসের জন্য ব্যবহৃত হয়। রাজার ছেলেমেয়েদের আরাম আয়েসের জন্য দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করা হয়।

“গনতন্ত্র” জিনিষটা আসলে কি?   একজন প্রতিনিধির চরিত্র সম্পর্কে না জেনে তার সুন্দর চেহারা ও মিস্টি ব্যবহার দেখে জনগন ভেবে নেয় যে এই লোক এমপি হলেই এলাকার কল্যাণ করবে কিন্তু এমপি হবার পরে সেই এলাকাতে তাঁকে কোন দিন দেখা যায়না। দেখা যায় টিভিতে । দেখা যায় বিদেশে। দেখা যায় বড় বড় বিজিনেস ডিল করতে কিন্তু সেই এলাকার কল্যাণ আর হয়না। সেই এলাকাতে ধীরে ধীরে রাস্তা ভেঙ্গে যায়, নদী ভরাট হয়ে যায়, চিকিৎসার অভাবে হাসপাতালে রোগী মরে যায়, সেই এলাকার নদীর পানি ভারত খেয়ে ফেলার ফলে সেই এলাকাতে মরুভুমি হয় , সেই এলাকার চাষীরা শহরে আসে, ভিক্ষা করে, ইয়াবার চালান পৌছে দেয়, সেই এলাকার চাষীদের মেয়েরা ভারতে পাচার হয়ে যায়, সীমান্তে গার্ডদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়, সেই এলাকার শ্রমিকেরা বিল্ডিং চাপা পড়ে মরে যায়, সেই এলাকার শ্রমিকেরা বিদেশে যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে না খেয়ে দিনের পর দিন অনিশ্চিতভাবে অপেক্ষা করে তাদের উদ্ধারের। সেই এলাকার জনপ্রতিনিধি একজন রাজা। তার ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর কারুকে দেওয়া যাবেনা। রাজা এমপি কিন্তু সেই এলাকাতে গুন্ডা পালেন। নিজে আসেন না। গুন্ডারা চান্দা উঠায়। সবাই সেই এমপীর ভয়ে বা গুন্ডাদের ভয়ে তঠস্থ থাকে। সেই এমপীর ছেলে সেই এলাকার যেকোন মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে বা ঘরে ঢূকে ধর্ষন করে গাছে ঝুলিয়ে চলে যেতে পারে।

এইভাবে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রজারা গনতান্ত্রিক অধিকারের মাধ্যমে তাদের নিজেদের জন্য রাজা নির্বাচন করে। অতীতে জমিদারদের বাসার সামনে দিয়ে নিচু জাতের চাষাভুষা দরিদ্র মানুষ বা মুসলমানেরা জুতা মাথায় নিয়া হাটতো। ভয়ে কাপত। এখন হাজার হাজার মানুষ সেই এলাকার এমপীর ফেসবুকে যেয়ে লাইক দিয়া বলে — হজুরের বাপ অনেক বড় চেয়ারম্যান আছিল, হুজুরে তো বিলাতের বারিস্টার, হুজুরের অনেক বড় বড় মিল কল কারখানা আছে। হুজুরে আমাদের এলাকার এমপি। টিভিতে সবাই দ্যাখে । গর্বভরে। এই এমপিরে এমপি বানাইতে পেরে এমপিরে চুরি করতে সুযোগ সৃষ্টি করে সেই এলাকার জনগনে অনেক গর্বিত।  উনি অনেক বড় জমিদারের নাতিন । এমপীর সব আছে কিন্তু এমপীর এলাকার লোকের কিছু নাই।

এখন আসি “গনতন্ত্র” শব্দের উৎসমুখে। এই শব্দ কোথা হইতে আমদানী করা হয় ? এইখানেই শুরু হলো সব চাইতে মজার কাহিনী।

সমাজতন্ত্র শব্দটি শুনলেই অনেকের চোখের সামনে হাজী রাশেদ খান মেনন বা হাজী ইনুর চেহারা ভেসে উঠে। আসলে সমাজতন্ত্রের সাথে এই দুই হাজীর কোন সম্পর্ক নাই। যেমন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল কোন সমাজতান্ত্রিক দল না। এইটা আওয়ামীলীগ ভেঙ্গে দুই টুকরার একটা ফালতু টুকরা। বাকশালেও সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বাকশালের মূলমন্ত্র হইলঃ গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। সমাজতন্ত্র হইল – একটি সমাজের সমস্ত সম্পদ সকল জনগনের ভেতরে সমানভাবে বিতরণ করা। যদি দেশের সম্পদ সীমিত থাকে তাহলে গোটা সমাজের সবাই কম পাবে কম খাবে তাই সমাজের সব মানুষ কাজ করবে সম্পদ বৃদ্ধি করার জন্য ও সবার চাহিদা মেটানোর জন্য। সমাজের সবাই সাধ্যমত দেবে আর দরকার অনুযায়ী নেবে। এই হলো সমাজতন্ত্র। জনগন হলো দেশের মালিক। জনগন তাদের নিজেদের চাহিদা মেটানোর জন্য নিজেরা কাজ করবে । সাধ্যমত দেবে আর দরকার মত নেবে তাহলে তো সমাজে কেউ পুঁজিপতি হতে পারবেনা। পূঁজি বন্টন হয়ে যাবে সবার মাঝে। মানুষের মৌলিক চাহিদা – ভাত, কাপড়, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিশ্চিত করতে রাস্ট্রের সম্পদ/পুজি বিনিয়োগ করা হলে ব্যক্তি মালিকানাতে পূঁজি ধরে রাখার প্রশ্নই উঠেনা। অন্যদিকে ব্যক্তি মালিকানাতে যদি পূঁজির পাহাড় জমে তাহলে সমাজের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার প্রশ্নই উঠেনা। বেশীরভাগ মানুষের মধ্য “আমি ও আমার পরিবার” একা খাবো – “আমি আর আমার পরিবার” শুধু বাড়ি, গাড়ীর মালিক হলো। “আমি ও আমার পরিবারের” জন্য “তুমি ও তোমার পরিবার” ভাতের বিনিময়ে কাজ করবে– এই প্রবণতা থাকার ফলে “সমাজতান্ত্রিক” সমাজ ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়।

তখন পুঁজিপতিরা এই “গনতন্ত্র” শব্দের আবিস্কার করলো । “গনতন্ত্র” জনগনকে কি দিবে? শান্তনা পুরস্কার।

আমরা আমাদের মনের মানুষকে সেই জমিদারের ছেলেকে আমাদের ভাগ্যবিধাতাকে এমপি বানিয়েছি। এমপি সাহেবকে আমরা ভোট দিয়া নির্বাচিত করেছি। আমাদের গনতান্ত্রিক অধিকার আছে। তোমার এলাকার জন্য এমপিই সাহেব কি করেছে ? কিছুনা। মাঝে মাঝে দেখি হাটুজলে লাশ ভাসে। বিএসএফ গুলি করে লাশ ফেলায়। আমার এমপি কি করবে? উনি তো জমিদারের ছেলে উনার এইগুলা দেখার কাম না। উনি সব সময় বিদেশে বিদেশে থাকেন । ঢাকা শহরের গুলশান, বনানীতে থাকেন। উনি কি আমাগোর এলাকাতে আসবেন নাকি!! আমাদের কিন্তু ভোটাধিকার কেউ ছিনিয়ে নেয় নাই। আমরা ভোট দিতে পারি ।আমরা গর্বিত। আমাদের পেটে ভাত নাই, মাথার উপরে ছাদ নাই, কাজ নাই, কিছু নাই তবু ভোটাধিকার আছে। পুঁজিপতিরা খুশী । পুঁজিপতিদের মোসাহেব সরকার বাহাদুর বা রাজা বাহাদুর খুশী। ভোট দিতে পেরে জনগন খুশী। সবাই খুশী। তবু কেন যেন এই খুশী সেই খুশী না। ভোটাধিকার থাকার পরেও জনগন প্রজাই রয়ে যায় আর প্রশাসনিক যন্ত্র দিয়ে রাজারা ক্ষমতায় বসে টাকা বানায়। আরাম করে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *