পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রধান মিত্র হয়েই থাকবে

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সাথে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করবে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সামরিক বন্ধনের প্রকৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষক ওমর হামিদ জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়েচে ভেলেকে (ডি ডব্লিউ) বলেছেন যে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রধান মিত্র হয়েই থাকবে।
পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সারতাজ আজিজের সাথে ইসলামাবাদে মঙ্গলবার এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কেরি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে চলমান সামরিক অভিযানের প্রশংসা করেন। তিনি আফগানিস্তান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী সকল জঙ্গি গ্রুপের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যও পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানান।
কেরি বলেন, পাকিস্তান সরকারের উচ্চতম পর্যায়ের সাথে আমাদের পরিষ্কার কথা হয়েছে পাকিস্তানকে সকল জঙ্গি গ্রুপকে, হাক্কানি নেটওয়ার্ক ও অন্যদেরকে লক্ষ্যবস্তু করতে হবে যারা মার্কিন জোট ও আফগান বাহিনী এবং পাকিস্তান ও বিভিন্ন দেশের লোকদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর পেশাওয়ার স্কুলে গণহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার অঙ্গীকার করেছে। এতে ১৫০ জন নিহত হয় যাদের অধিকাংশই ছিল স্কুল শিশু। তালিবানদের এ হামলার পর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী গোলযোগপূর্ণ ওয়াজিরিস্তান এলাকায় ইসলামপন্থী জঙ্গিদের উপর স্থল ও বিমান হামলা জোরদার করেছে। ধারণা করা হয় যে এ অঞ্চলের অত্যন্ত ভয়ংকর জঙ্গীরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর উপর হামলা চালানোর ক্ষেত্র হিসেবে ওয়াজিরিস্তানকে ব্যবহার করছে। পাকিস্তানের সেনা অভিযান শুরু পর উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান থেকে লাখ লাখ লোক পালিয়ে গেছে।
আইএইচএস-এ এশিয়া প্যাসিফিক কান্ট্রি রিস্ক-এর প্রধান ওমর হামিদ ডি ডব্লিউ’র সাথে সাক্ষাতকারে বলেন, হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পাশাপাশি ওয়াজিরিস্তানে তাদের অভিযান পাকিস্তানের উপর মার্কিন আস্থা বৃদ্ধি করেছে এবং দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।
ডি ডব্লিউ: তালিবান বিদ্রোহীদের সাথে পাকিস্তানের সমস্যা নতুন কিছু নয়। উগ্রপন্থী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চলার সময়টাকেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানাতে বেছে নিলেন কেন?
ওমর হামিদ: গত ছয় মাস বা এ রকম সময় ধরে পাকিস্তান তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও অন্যান্য জঙ্গী দলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান হাক্কানি নেটওয়ার্কসহ সকল তালিবান সংশ্লিষ্ট গ্রুপগুলোর বিরুদ্ধেই পরিচালিত হচ্ছে। হাক্কানি নেটওয়ার্ক বিশেষ করে কাবুলসহ আফগানিস্তানে বড় ধরনের হামলার জন্য দায়ী। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তান সরকার হাক্কানি নেটওয়ার্ককে রক্ষার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করে।
যাহোক, সর্বশেষ এ পদক্ষেপ আস্থা বৃদ্ধি এবং তা ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডি ডব্লিউ: যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে কী ধরনের সহযোগিতা দিতে ইচ্ছুক?
ওমর হামিদ: পাকিস্তান মূলত বৃহত্তর মার্কিন সামরিক সহযোগিতায় আগ্রহী। উত্তর ওয়াজিরিস্তানে সাম্প্রতিক অভিযানে অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন লোকদের পুনর্বাসনেও সরকারের সাহায্য প্রয়োজন। যাহোক, কেরি ল্যুগার বিলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুধু সামরিক বাহিনীকে অধিকতর সাহায্য দেয়ার বদলে বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর গুরুত্ব প্রদান করেছে। এখানে প্রকৃত বিষয় হল যে এ সময় পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহত থেকেছে যদিও দু’পক্ষের মধ্যে কিছু সময় বাগযুদ্ধ চলেছে।
ডি ডব্লিউ: এ বাগযুদ্ধ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র কেন মনে করে যে পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া গুরুত্বপূর্ণ?
ওমর হামিদ: দু’টি কারণে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রধান মিত্র হয়ে থাকবে। প্রথমত, সেনাবাহিনী হচ্ছে একমাত্র শক্তি যারা উপজাতীয় এলাকার আশ্রয়স্থলগুলো থেকে ইসলামপন্থী জঙ্গী গ্রুপগুলোকে বিতাড়িত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করে যে আফগান তালিবানকে অর্থবহ শান্তি আলোচনায় রাজি করাতে পাকিস্তানকে তাদের দরকার।
ডি ডব্লিউ: আপনি ওয়াজিরিস্তানে অভিযানের কথা উল্লেখ করেছেন। ইসলামাবাদ তার নিজস্ব অভিযান শুরু করা সত্ত্বেও উপজাতীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র বারবার বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানি কর্মকর্তারা এ ড্রোন হামলাকে সার্বভৌমত্বের লংঘন বলে নিন্দা করেছেন। দু’সামরিক বাহিনী কি এ অভিযানে একসাথে কাজ করছে?
ওমর হামিদ: প্রকাশ্য নিন্দা সত্ত্বেও বিভিন্ন সাক্ষ্য-প্রমাণে বোঝা যায় যে পারস্পরিক সংযোগেই এ ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে এবং পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্দেশে। মার্কিন ড্রোন হামলার লক্ষ্য টিটিপি প্রধান মোল্লা ফজলুল্লাহও যিনি আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে আছেন বলে ধারণা করা হয় এবং সম্প্রতি সন্ত্রাসবাদীদের যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী তালিকায় যার নাম যুক্ত হয়েছে।
ডি ডব্লিউ: কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন যে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী হাক্কানি নেটওয়ার্ককে ‘সম্পদ’ বলে মনে করে এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে। আপনি কী মনে করেন?
ওমর হামিদ: আগে সম্পর্ক যাই থাক, বর্তমান অভিযানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী হাক্কানি নেটওয়ার্ককে লক্ষ্যবস্তু করেছে। এর ফলে সম্প্রতি হাক্কানি নেটওয়ার্কের আক্রমণ সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। নভেম্বরে ওয়াশিংটন সফরকালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান রাহিল শরীফ বর্তমান অভিযানে হাক্কানি নেটওয়ার্ককে ছাড় না দেয়ার জন্য পেন্টাগন নেতৃত্ব ও মার্কিন প্রশাসনের অন্যদের প্রশংসা লাভ করেন।
ডি ডব্লিউ: পাকিস্তানের প্রতি কেরির সহায়তার অঙ্গীকার প্রতিবেশী ভারতের সাথে উত্তেজনা অবসানে কিভাবে সহায়ক হতে পারে?
ওমর হামিদ: পাকিস্তান সব সময়ই ভারতের সাথে কাশ্মীর বিরোধ নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ চেয়েছে। এ ধরনের সরাসরি সমর্থনের যখন সম্ভাবনা নেই, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্কের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এ ভেবে সন্তোষ লাভ করতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনমূলক মন্তব্যের আলোকে ভারত একতরফাভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে যা দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।
ডি ডব্লিউ: ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সহিংসতা হ্রাসে সাহায্য করতে ইসলামাবাদের উপর ওয়াশিংটন কতটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে?
ওমর হামিদ: অর্থনৈতিক সহায়তার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য রকম চাপ প্রয়োগ করতে পারে যা নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সহিংসতা হ্রাসে ব্যবহার করা সম্ভব। তবে এটাও বুঝতে হবে যে সহায়তা বা অর্থনৈতিক সমর্থন হ্রাস সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে পাকিস্তানের সমর্থন খর্ব করতে পারে যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান স্বার্থ।

আতিক/প্রবাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *