মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের অতীত ও বর্তমান হালচাল

‘মেহু ডন। ডনকে পাকাড়না বহুত মুসকিল হে।’ সিনেমার সংলাপ হলেও এই সংলপের বাস্তব রূপ দান করেছেন, বাস্তব জীবনে এমন ডন ও আছে।বলিউড সিনেমার ডন শাহরুখ খান বাস্তব জীবনে ডন না হলেও মুম্বাইয়ের বাস্তব ডন দাউদ ইব্রাহিম কাসকার। ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৫৫ সালে জন্ম নেই মুম্বাই সহ পৃথিবী কাঁপানো এই মাফিয়া ডন। দাউদ ইব্রাহিম নামেই বেশি পরিচিত যিনি ভারতের মুম্বাই এর সংগঠিত অপরাধ চক্রের প্রধান। তার সিন্ডিকেটের নাম হলো ডি কম্পানি।তিনি সংগঠিত অপরাধের জন্য ইনাটারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় এবং মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস-এর বিশ্বের শীর্ষ পলাতক অপরাধীদের ২০১১ এর তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছেন।এছাড়াও ২০০৮ সালেও তিনি ফোর্বস-এর তালিকায় চতুর্থ স্থানে ছিলেন।ভারতীয় পুলিশের পলাতক অপরাধীদের তালিকায়ওতার নাম শীর্ষে। দাউদ ইব্রাহিমের দলে প্রায় ৫ হাজার সদস্য রয়েছে যারা মাদক চোরাচালান থেকে শুরু করে খুন, অপহরন এর মত কাজ করে থাকে। ছোটা শাকিলকে দাউদ ইব্রাহিম এর ডান হাত হিসেবে ধরা হয়।তাদের কর্মক্ষেত্র ভারত, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব অমিরাত।১৯৯৩ সালে ১২ মার্চ মুম্বাই স্টক এঙ্চেঞ্জে এক সিরিজ বোমা বিস্ফোরণে ৩১৫ জন (সরকারি হিসেবে ২৫৭ জন) লোক নিহত হয়।এর জন্যও দাউদ ইব্রাহিমকে অভিযুক্ত করা হয়। ২১ মার্চ ২০১৩ সালে ইন্ডিয়ান সুপ্রীম কোর্ট এক নিরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারে এই বোমা হামলায় দাউদ ইব্রাহিম সরাসরি জরিত ও তিনি পাকিস্তানে আত্মোগোপন করে আছেন যাদিও পাকিস্তান সরকার ভারতের এই দাবি বারবার অস্বীকার করে আসছে।

পুলিসের প্রধান কন্সটেবল ইব্রাহিম কাসকারের পুত্র দাউদ ভারতের মহারাষ্ট্রের কনকান অঞ্চলের রত্নগিরি জেলার মামকা গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি মূলত কনকানি মুসলমান সম্প্রদায় থেকে এসেছেন।তিনি প্রথমে মুম্বাই এর করিম লালা গ্যাং এ কাজ করতেন এবং পরে সংযুক্ত অরব আমিরাতের দুবাই চলে যান এবং সেখান থেকেই তার অপরাধের সম্রাজ্য বিস্তৃত করতে থাকেন। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৭.৫ হাজার কোটি রুপী।

শিপিং,এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁর বিনিয়োগ আছে এবং ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে তাঁর ব্যবসার স্বার্থ।পারিবারিক জীবনে দাউদের মেয়ে, মাহরুখ ইব্রাহিম পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াদাদ এর ছেলেকে বিয়ে করেন। যুক্তরাজ্যে লেখাপড়ার সময় তাদের মধ্যে পরিচয় হয়। ২০০৯ সালের ৩০ মার্চ দাউদের ভাই নোরা ঘুমের মধ্যে মারা যায়। এছাড়া আরেক ভাই আনিস ইব্রাহিমও মুম্বাই হামলার অন্যতম আসামী।দাউদের থেকে ১০ বছরের ছোট ভাই ইকবাল কাসকার মুম্বাইয়ে দাউদের ব্যবসা দেখাশোনা করেন।

ইকবাল ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত একটা হত্যা মামলায় চার বছর জেল খেটেছেন।মীরা রোড, ভাইয়ান্দার ও মধ্য মুম্বাইয়ের রিয়েল এস্টেটে তাঁর বিনিয়োগ আছে বলে শোনা যায়। দাউদের বোন ৫২ বছর বয়স্কা হাসিনা পারকার ২০০৩ সালে আমিরাত থেকে ইকবালের প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত দাউদের সাম্রাজ্য চালিয়েছিলেন। চলচ্চিত্র দাইদ ইব্রাহিমের অপরাধ জীবনের ঘটনা নিয়ে বলিউডে কয়েকটি চলচ্চিত্রও নির্মান করা হয়েছে। ব্ল্যাক ফ্রাইডে (২০০৪), ডি (২০০৫),শূটআওট অ্যাট লোখান্ডওয়ালা (২০০৭), ওয়ান্স আপন অ্য টাইম ইন মুম্বাই (২০১০),শ্যূটআউট অ্যাট ওয়াদালা (২০১৩)।এ সব চলচিত্রে দাউদ ইব্রাহিমের দেখা গোয়েন্দা সংস্থা পেলেও বাস্তবে তাকে কখনো হাতের লাগলে পাননি।তাই আজও এই মাফিয়া ডন রাজ করছেন মুম্বাই সহ সারা পৃথিবী।

বছর কয়েক আগ থেকে শোনা যেতে থাকে দাউদ ইব্রাহিম স্বস্তিতে নেই। কারন কি হতে পারে !? আসুন বাকি কাহিনী শুনি..

মুম্বাই এ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে খুন। ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় সম্প্রতি মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের উপর একটি ফিচার প্রচার করে। তাতে দেখা যায়, লাদেনের মারা যাবার পর থেকে মাফিয়া ডন ইব্রাহিম কিছুটা শংখিত। নিজের আধিপত্য শেষপর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাড়াবে তা নিয়ে দাউদ চিন্তিত। মুম্বাই এ সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন দাউদের ভাই ইকবাল কায়সারের ড্রাইভার। সন্ত্রাসীরা যে ইকবাল কায়সারকে হত্যার জন্য গুলি চালিয়েছিল তার কোন সন্দেহ নেই। তবে প্রানে বেচে যান ইকবাল। দাউদের ভাই ইকবালের রাজত্ব মুম্বাই। দাউদের কাজগুলো ইকবাল ভারতে বসে সম্পাদন করে। নিয়ন্ত্রন করে নেপালও। দাউদের মতো ইকবালেরও রয়েছে বিশাল দেহরক্ষি বাহিনী। যেখানে পুলিশের প্রবেশও নিষিদ্ধ। ইকবালের বাড়ি থেকে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার মাসোহারা যায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে। প্রশাসন থেকে শুরু করে ছোট ছোট বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর কাছে অর্থ যায়। আর এসব অর্থের বিনিময়ে দাউদের হয়ে কাজ করে গ্রুপ গুলো। দাউদের ভাই এর ড্রাইভারকে যারা হত্যা করেছে তাদেরও তড়িৎ গতিতে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। ২০০৩ সাল থেকে গ্যাংস্টার এজাজের সাথে ইকবাল ভারতের মুম্বাই এ আসন গাড়ে। ইতিমধ্যে ডন ইব্রাহিমের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছোটা শাকিলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তার ভাইকে যারা মারতে চায় তার প্রতিশোধ নিতে। দাউদ ইব্রাহিম বর্তমানে করাচিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তাকে সেল্টার দেয় পাকিস্তান সরকার। তার সাথে রয়েছেন অন্য ভাই আনিস। তাদের সার্বক্ষনিক পাহারা দেয় ছোটা শাকিল, টাইগার, আফতাব, ইয়াকুব, ফাহিম প্রমুখ কমান্ডাররা। মাওবাদি সন্ত্রাসীদের জন্য দাউদের মসোহারা রয়েছে। বিশেষ করে নেপালের মাওবাদীদের নিয়ন্ত্রন করে ডন দাউদ। দাউদের যে ক’জন বিশ্বস্ত লোক রয়েছে তার মধ্যে আফতাব বাতকি অন্যতম। এ আফতাবের কাজ হলো বিশ্বে বিভিন্ন দেশে জাল টাকার বিস্তার করা।দুবাই থেকে আফতাব সব নিয়ন্ত্রন করে। ভারতের জাল মুদ্রা ব্যবসায় দাউদের লোক কে এম আবদুল্লাহ গ্রেফতার হলে জাল টাকার ব্যবসা কিছুটা থমকে যায়। তার হাত রয়েছে বাংলাদেশ পর্যন্ত। বাংলাদেশেও জাল টাকা বা ডলারের সাথে দাউদের হাত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। নেপালের স্টক মার্কেটে দাউদের অর্থ খাটে। এমনকি নেপালের অনেক মন্ত্রী চলে দাউদের টাকায়। ভারতের দাউদের রয়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। রিয়েল এস্টেট থেকে শুরু করে গার্মেন্টস পর্যন্ত এ ব্যবসার প্রসার দ্রুত বাড়ছে। ১৯৯৩ সালে মুম্বই এ সিরিজ বোমা হামলায় আসামী রয়েছে দাউদের ভাই আনিস। সেই থেকে আনিস ভারতে যেতে পারে না। তবে ভারতে ফ্লিমস্টারদের সাথে দাউদের যে ব্যবসায়ীক লেনদেন রয়েছে তাতে কিছুটা ভাটা চলছে। অনেকের জানা দুবাই ভিত্তিক আল মনসুর ভিডিও এবং করাচি ভিত্তিক সাদাফ ট্রেডিং কোম্পানি দাউদের। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দাউদ পাইরেটেড ভারতীয় ছবি বিক্রি করেন। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র’র” মতে, ভারতের ১ বিলিয়ন ডলারের পাইরেসি ব্যবসার ৭০ ভাগই দাউদের দখলে। দাউদের অন্যতম খাস লোক ইকবাল মিরচির মাধ্যমে চলে মাদক ব্যবসা। অস্ত্র ব্যবসায় কিছুটা মন্দ চলছে। তবে লাদেন হত্যা দাউদের জন্য বিশাল এক হতাশার খবর। কারন লাদেনের সাথে দাউদের সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। এতদিন লাদেনের পেছনে সবাই ব্যস্ত থাকতো বলে দাউদের খবর নিতে কেউ তেমন ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। এখন আন্ডার ওয়ার্ল্ডের নতুন ডনদের নজরে আছে দাউদ ইব্রাহিম। তাই শংকা বাড়ছে দাউদেরও।

 

দাউদ ইব্রাহিম একজন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও মাফিয়া ডন হওয়ার পরেও তাঁর রয়েছে অসংখ্য ভক্ত দুনিয়া জুড়ে !!

ভারতের অপরাধ বিশেষজ্ঞরা এখন পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারেন নি এর রহস্য কোথায়।

 

জাবের/প্রবাসনিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.