শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাণিজ্য

দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে ইতিমধ্যে ভর্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে। নতুন বই হাতে ক্লাসেও যেতে শুরু করেছে কোমলমতি শিশুরা। রাজধানীর নামকরা বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে শিশুদের যেমন মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, তেমনি তাদের অভিভাবকরাও একপ্রকার চাপে ছিলেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ভর্তি ফি গুনতে গিয়ে আর্থিক চাপের মুখে পড়েছেন। এ অবস্থায় বিশিষ্টজনরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন একপ্রকার ‘বাণিজ্যে’ পরিণত করেছেন। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, অথচ এটি নিশ্চিত করতেও এখন অতিরিক্ত অর্থের লেনদেন করতে হচ্ছে। তাদের মতে, লাগামহীন ভর্তিবাণিজ্য রোধে সরকারের নজরদারি আরও বাড়ানো প্রয়োজন।

ঢাকার বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি ফি ও উন্নয়ন ফির নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয় তা নিয়ে কয়েকজন অভিভাবক বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে অভিযোগ করেন। ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করতে সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব স্কুলেই সরকারি আদেশ, নির্দেশ, অনুরোধ এবং আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে লাগামহীন ভর্তি ফি। যা এখনো অব্যাহত আছে। অথচ দুই বছর আগেই রাজধানীর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়ের সময় অভিভাবকদের অভিযোগের পর বিষয়টি পত্র-পত্রিকায় আসে। সে সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত শেষে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি আদায় করা অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। সরকারি নিয়মে রাজধানীর স্কুলগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে ৫ হাজার টাকার অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার নিয়ম নেই। অথচ স্কুলে ভর্তি ফি ছাড়া ডোনেশন বাবদ মনিপুর স্কুল নিচ্ছে ২০ হাজার টাকা আর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে ভর্তির জন্য নিচ্ছে ১২ হাজার ২০০ (বাংলা মাধ্যম) আর ১৪ হাজার ১০০ টাকা (ইংরেজি মাধ্যম) করে। আইডিয়াল স্কুলের মূল শাখা ১৩ হাজার ৭০০ টাকা (বাংলা), উইলস লিটল ফ্লাওয়ারে ৯ হাজার টাকা, অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৭ হাজার ৮৮০ টাকা, উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ হাজার ২০০ টাকা এবং মতিঝিল মডেল স্কুলে প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তির জন্য ১২ হাজার টাকা করে আদায় করা হয়। নীতিমালায় বলা হয়, ভর্তি ফি ও ফরম বাবদ সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করা হলে এমপিও বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধনের জন্য শিক্ষা বোর্ডের ১ হাজার ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ টাকা ফি নেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু বাস্তবে স্কুলগুলোতে এর থেকে সাত-আট গুণ বেশি অর্থ আদায় করা হয়েছে। এদিকে চলতি শিক্ষাবর্ষে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি ফরমের ও সেশন ফি বাড়ানো হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেশের আইনি ব্যবস্থার প্রতি অবজ্ঞা করে। এ কারণেই শিক্ষাবাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। আমি মনে করি, শিশুদের নিয়ে বাণিজ্য করা উচিত নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা কমিটিকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাগামহীন ভর্তি ফি আদায় না করে স্কুলগুলোর ব্যয়ভারের জন্য বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। স্কুলগুলো নামে-বেনামে অভিভাবকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত তাদের মানতে হবে। কারণ, সরকার নির্ধারিত ভর্তি ফি-ই যথেষ্ট। জানা যায়, এসএসসি পরীক্ষায় ফরম পূরণ বাবদ অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধে গত ১০ নভেম্বর উচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দিয়েছেন। এটি তোয়াক্কা না করায় ১৪ ডিসেম্বর বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ রাজধানীর ২৬টি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে উচ্চ আদালতে তলব করেন। যে ২৬টি বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভর্তি ফি নেওয়ার অভিযোগ ছিল তার মধ্যে আছে- ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, মিরপুর বাঙলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল হাইস্কুল, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, লালবাগ রায়হান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আনন্দময়ী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, আজিমপুর ওয়েস্টার্ন হাইস্কুল, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিরপুর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে মাত্র ৬টি স্কুল অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল। আর ৭টি স্কুল এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু বাকিরা কিছু করেনি।

২ thoughts on “শিশু শিক্ষার্থীদের নিয়ে বাণিজ্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *