আপনি সন্ধ্যায় অফিস শেষে বাড়ি ফিরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে এক মুঠো সর্ষেমাখানো মুড়ি মুখে পুরে দিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে টিভি রিমোটের অন বাটনে চাপ দেন। কেন বাপু, এত নিয়ম কানুন মেনে অন বাটন চাপতে হবে কেন? এই অন বাটন চাপার সাথে বাঙালির পুরো কর্মক্লান্ত দিনের ক্লেশ মুছে ফেলার তীব্রতা কাজ করে। টিভি পর্দার অবিরল বিনোদনধারা বাঙালির ক্লেদ-ক্লান্তি মুছে ফেলে সজীব আনন্দ দেয়। এই মুলুকে দুরদর্শনযন্ত্র প্রবেশের পর থেকে এইটাই রেওয়াজ হয়ে চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সে-ও বছর পঞ্চাশেক তো বটেই।
কিন্তু টিভি যে বিনোদনের উৎস, সেটা এখনো বিনোদনপিয়াসী বাঙালির মনে থাকলেও বিনোদন দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছেন টিভি চালকরা। এখন একটির স্থলে ডজন দুই টিভি চ্যানেল ঢাকার আকাশজালে থাকলেও বিনোদন বৃদ্ধির বদলে কমতে কমতে তা সিকিতে পৌঁছেছে। কখনো সেটা শূন্যের কোটায়।
থার্টিফার্স্ট নাইটে কলকাতার একটি টিভি চ্যানেলে কলকাতা পুলিশ বাহিনীর আয়োজনে একটি কনসার্ট দেখছিলাম। পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলও কনসার্ট দেখাচ্ছিল। বাংলাদশি টিভির আয়োজন কতটা নিম্নমানের, কতোটা দরিদ্র, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। মাইক এবং ড্রাম নিয়ে হাউকাউ ছাড়া বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল আর কিছু দেখায় না। কোনো মেধার ছোঁয়া নাই, পরিকল্পনা নাই, চোখ ধাঁধানো কিছু নাই।
ঢাকার টিভি চ্যানেল মানে এখন সংবাদ আর বচন বিনোদন (টক শো)। প্রভাতে টকশো, অপরাহ্নে টকশো, সন্ধ্যায় টক শো, রাতে টকশো, টক শো সদা দৃশ্যমান। গভীর রাতে ঘুম থেকে থেকে উঠে উঁকি দিয়ে দেখেন অনেকে, তারা (টকিস্ট) আছে কিনা? তারা আছেন, ক্লান্ত, ঢুলুঢুলু চোখে বকে চলেছেন তারা। অবিশ্রান্ত কথন তাদের চলতেই থাকে। টিভিতে যে নৃত্য-গান-নাটক-চলচ্চিত্র-কৌতুক বলে কিছু জিনিস ছিল একসময়, সেটা কেন টিভিকর্তারা বিস্মৃত হয়েছেন ভেবে বিস্মিত হই।
খবর কখনো খাবার হতে পারে না।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ করে আমরা স্যাটেলাইটে প্রবেশের পর থেকে এই খাদ্য আমাদের প্রায় মেরে, ধমক দিয়ে, গলা টিপে- গেলাচ্ছেন টিভিওয়ালারা।
অথচ কিছু দিন আগেও বাংলা টিভিজগতে বাংলাদেশের চ্যানেলই ছিল বিনোদনে, গৌরবে, মহিমায় অদ্বিতীয়। ১৯৮৯ সালে কলকাতার টেলিভিশন পত্রিকায় জ্যোতির্ময় দত্তর লেখা পড়লে বোঝা যায় তখন বাংলাদেশের চ্যানেলের মান ও গুণে কতোটা ব্যাথাতুর ঈর্ষা অনুভূত হত তাদের। এপ্রিল ১৯৮৯ সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন- “ঢাকার রাস্তাঘাট কলকাতার চেয়েও চওড়া এবং মসৃণ হবে এটা মানা যায়। ঢাকা কি একটা যেমন তেমন শহর। ঢাকা একটি স্বাধীন রাজ্যের রাজধানী।
যেখানে একজন রাষ্ট্রপতি আছেন, প্রধানমন্ত্রী আছেন, আছে নিজস্ব যোজনা-কমিশন এবং মহানগর উন্নয়ন সংস্থা। কলকাতার প্রয়োজন দিল্লীর প্রায়োরিটি লিস্টের খুবই নিচের দিকে। বাংলাদেশে ঢাকাই হচ্ছে টপ। কিন্তু ঢাকা কলকাতার চেয়ে এগিয়ে যাবে নাটকে, কবিতায়, টিভি সিরিয়ালে… এতে ভয়ানক আঘাত লাগে। এটা মানা যায় না। অথচ সত্য তা’ই। ……. চ্যানেল ঘুরালেই মন ভালো করে দেয় বাংলাদেশের নাটক। বাংলাদেশ নাটকের স্ট্যান্ডার্ডই আলাদা। যেমন স্ক্রিপ্ট তেমন গল্প তেমনি অভিনয়। কলকাতার প্রযোজকদের উচিত বাংলাদেশে গিয়ে কিভাবে নাটক প্রযোজনা করতে হয় সে ব্যাপারে কয়েকমাস ট্রেইনিং নেয়া।”
– টেলিভিশন, এপ্রিল ১৯৮৯, কলকাতা
অত্যন্ত বেদনার হলেও সত্যি- পাশার দান উল্টে গেছে। বাংলাদেশের প্রযোজকদেরই এখন উচিৎ কলকাতায় গিয়ে কিভাবে টিভি অনুষ্ঠান প্রযোজনা করতে হয় সে ব্যাপারে কয়েকমাস ট্রেইনিং নেওয়া।
বাংলাদেশে টিভি চ্যানেল মানে গঁৎবাধা অনুষ্ঠান। গানের অনুষ্ঠান হলে দু’চেয়ারে দু জন বসে; উপস্থাপক এবং গায়িকা, কী খেতে ভালো লাগে কী পরতে ভালো লাগে কথা চালাচালি করে মাঝেমাঝে গান গাওয়া। এগুলোর প্রত্যেকটাই আবার সরাসরি প্রচার হয়। প্রত্যেক চ্যানেলে একই হাল। তারকাদের লাইভ আড্ডা হয়। লাইভ আড্ডায় মঞ্চের দু’পাশে দু’সেট সোফা থাকে। দু’ দু গুণে চারজন উঠতি বা পড়তি তারকা থাকে। এরা আধা ঘণ্টা কৃত্রিম হাসাহাসি করবে। খেজুরে আলাপ করবে। একজনের কথা শুনে অন্যরা হাসি না এলেও কষ্ট করে হলেও হাসবে। মাঝে পর্দার পেছন থেকে কোনো টিভি ক্রু টেলিফোন কল করে প্রশ্ন করেন। এর নাম দেওয়া হয় দর্শক ফোন। দর্শক কই, সবই কলাকুশলী।
ডেইলি আট দশটা সংবাদ, হাফ ডজন টকশো, রান্নার অনুষ্ঠান, বিকালে একটা নাচের অনুষ্ঠান, সন্ধ্যায় লাগাতার সংবাদ, এরপর লাইভ গান/আড্ডা র নামে বিরক্তি, নয়টার দিকে ২০ মিনিটের ভাঁড়ামোমার্কা নাটক, মাঝে গ্যাপ পূরনের জন্য ছায়াছন্দ টাইপ প্রোগ্রাম; এগুলো দিয়েই চলছে বাংলাদেশের চব্বিশটি চ্যানেল। ফরম্যাট একই, শুধু লোগোটা আলাদা। মানহীন, বস্তাপচা, সস্তা অনুষ্ঠানই বাংলাদেশের টিভির জনপ্রিয়তা ধসের মূল কারণ।
টিভির সবচেয়ে কম বাজেটের অনুষ্ঠান হচ্ছে টকশো। দু’বক্তার জন্য দু’হাজার করে চার হাজার টাকা ধরিয়ে দিলে হয়, আর কিছু লাইট ফ্যান খরচ! আর এটাতে মেধাও প্রয়োজন নেই বিশেষ।
অন্যদিকে কলকাতার চ্যানেল মানে ঠাসা বিনোদন। সেখানে সংবাদ চ্যানেল বলতে শুধুই সংবাদ। গানের চ্যানেলে গান। ক্যাটাগরি ভিত্তিক আলাদা আলাদা চ্যানেল। জগাখিচুড়ি টাইপ কিছু নাই। তাদের চেষ্টাও চোখে পড়ার মতো। পাখি, রাশি এবং টাপুর টুপুরকে গালি দিয়ে কী লাভ ভাই? তারা তো জোর করে আমাদের খাওয়াচ্ছে না। আমরা নিজেরাই যাচ্ছি। কারণ একটাই, নিরেট বিনোদন চাই।
সংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কথা বলে এসব চ্যানেল বন্ধের কথা বলা হচ্ছে। এখানে অবক্ষয় যতটা তার চেয়ে বেশি ভয় দেশীয় চ্যানেলগুলোর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া। কলকাতার চ্যানেল বন্ধ করলেই কী আমরা অনুষ্ঠানে মানে ও গুণে উন্নততর অবস্থানে চলে যাব? সেটা যদি না হয়, তখনো দর্শকরা দেশীয় চ্যানেল দেখবে না। মেধা খাটিয়ে অনুষ্ঠান বানালে পাবলিক দেখবে।
ভারতে তাদের চ্যানেলগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে। এমনও দেখেছি, কোনো কোনো রাজ্যের আঞ্চলিক চ্যানেলগুলোর মান এতো সমৃদ্ধ যে সেখানে জাতীয় চ্যানেলগুলো কেউ দেখেই না। দক্ষিণের আঞ্চলিক চলচ্চিত্রের সাথে শাহরুখ, সালমানদের বলিউডি ফিল্মগুলোকে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছ যে, তামিল ছবিগুলো ভারতীয় সিনেমায় রাজত্ব করছে। অঞ্চল, ক্ষেত্র বা বাজার কোনো বাধা নয়। বাধা হচ্ছে মগজ। মগজ যদি অনুর্বর হয়, যদি ভালো কিছু প্রসব না করে তবে পিছিয়ে পড়বেনই।
আমাদের দেশে অধিকাংশ চ্যানেল মেধা ও প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তিরাই শাসন করছে। এদের অনুষ্ঠান দেখার কিছু নেই। মানুষ রিমোট হাতে নিয়ে এসব বস্তাপচা অনুষ্ঠান কেন দেখবে, বলেন? দিন শেষে ঠাসা বিনোদন চাই বাঙালির। তাই তো আমরা চ্যানেল ঘুরিয়ে ওপার বাংলায় চলে যাই।
-মনোয়ার রুবেল, কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।
ইমেইল: monowarrubel@yahoo.com