নতুন বছরে নতুন সংকল্প

অনেক প্রতিকূলতা পেড়িয়ে শেষ করতে যাচ্ছি আর একটি বছর। প্রবাসনিউজ২৪ কিছুদিনের জন্য বন্ধ ছিল। এই অনলাইন পত্রিকাটি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। একের পর এক চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার নামই জীবন। প্রবাসনিউজ২৪ এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করছে। প্রতিনিয়ত চেস্টা করছে অনলাইনে টিকে থাকতে ও পাঠকদের কাছে সংবাদ পৌছে দিতে।

২০১৫ সাল আমাদের জন্য সুখ, সমৃদ্ধি, স্বচ্ছলতা, শান্তি বয়ে আনুক – শুধু এই কামনা করলেই এই সুখ সমৃদ্ধি, স্বচ্ছলতা ও শান্তি একাকী আমাদের হাতে এসে ধরা দেবেনা। এইসব কিছু অর্জন করার জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শুধু পরিশ্রম করলেই হবেনা সেই সাথে এই পরিশ্রমের ফসলকে এমনভাবে কাজে লাগাতে হবে যাতে এই ফসল এককালীন মৌসুমী ফসল না হয়ে যায়। এই সমৃদ্ধির জন্য আমাদের ফিরে দেখতে হবে বিগত বছরে আমরা কেন ব্যর্থ হয়েছি, খতিয়ে দেখতে হবে ব্যর্থতার কারণগুলো,  সেই ব্যর্থতার পেছনে আমাদের নিজেদের কতটুকু নিয়ন্ত্রন ছিল, সেই ব্যর্থতা রোধে আমরা নিজেরা কতটুকু চেস্টা করেছি বা করিনি, সেই ব্যর্থতার পেছনে অন্য কোন কোন শক্তি জড়িত ছিল সেইসব কিছু।  সেইসব শক্তি বা সংগ বা কারনগুলোকে আগামী দিনগুলোতে যদি পরিহার করা যায় তাহলে হয়ত সুখ আসবে, শান্তি আসবে, সমৃদ্ধি আসবে। একটি সমাজের সকল আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যর্থতা গুলোকে যেহেতু আমরা একাকী নিয়ন্ত্রন করতে পারিনা সেহেতু আমাদের ব্যক্তিগত ব্যর্থতার জন্য আমরা নিজেরা নিজেদের ধিক্কার দিতে পারিনা। আমাদের সন্মিলিত অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে আমাদের অর্থনীতি। একদল লোক যদি অপচয় করে আর অন্য একদল লোক কঠোর পরিশ্রম করেও নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারবেনা। দেশের সম্পদকে যদি  সঠিকভাবে কাজে লাগানো না যায় আর যদি কিছু মানুষের হাতের মুঠিতে পুঁজি আটকে থাকে, যদি বিদেশী পন্যে বাজার ছেয়ে যায় তাহলে শ্রমিকের পারিশ্রমিক কমে যাবে, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি পাবে, মুদ্রাস্ফীতির হার বৃদ্ধি পাবে। এক মুঠো চাল কিনতে এক বস্তা টাকা নিয়ে বাজারে যেতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করে আয় বৃদ্ধি করলেও কোন লাভ হবেনা। ভাগ্যের পরিবর্তন হবেনা। সুখ, সমৃদ্ধি, স্বচ্ছলতা, শান্তি আসবেনা। সহজ উদাহরন, সম্পত্তি বিক্রি করে দালালের হাতে শেষ সম্বল তুলে দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যেয়ে আপনি যে টাকা আয় করবেন তা সবই খরচা হয়ে যাবে প্রতিদিনের জীবনযাপনের ব্যায়ভার বহন করতে। ধরে নিলাম কিছু টাকা আপনি সঞ্চয় করলেন কিন্তু এক সময় যখন আপনি এই সঞ্চিত টাকা দিয়ে সেই বিক্রি করে ফেলা সম্পত্তি কিনতে যাবেন তখন দেখবেন সেই জমির মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে আপনার ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। তাই বিদেশে যাবার আগে ভেবে দেখবেন দেশেই কিছু করা যায় কিনা। অনেকে দালাল ধরে বিদেশে যেতে চায় কিন্তু মাঝ পথ থেকে ফিরে আসে। অনেকে দালাল ধরে বিদেশে যায় কিন্তু কোন কাজ পায়না। অনেকে দালাল ধরে বিদেশে যায় কিন্তু ন্যূনতম মজুরীতে কাজ পায় ফলে বিদেশে যাবার মোট খরচা উঠানো সম্ভব হয়না। মালয়েশিয়া যাবার পথেই অনেকে জাহাজে মরে যায়। ধরুন আপনি ঋন করে বা সম্পত্তি বিক্রি করে দালালদের টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যাবার জন্য জাহাজে উঠলেন । মরে গেলেন। পেছনে ফেলে রেখে গেলেন সহায় সম্পদহীন ঋনগ্রস্থ প্রিয়জন, পরিবার ও সন্তান।

মালয়েশিয়া যাবার পথে সেদিন একটি নৌকাতে ১৯ জন বাংলাদেশী মারা গেছে। কক্সবাজারে এক ভদ্রলোকের ফার্নিচারের দোকান ছিল। এ্কদিন এক লোক সেখানে ফার্নিচার কিনতে এসে সেই ব্যবসায়ীকে বলে এই দোকানে তোমার যা আয় হয় তার চাইতে দুইগুন বেশী আয় করতে পারবে তুমি যদি মালয়েশিয়া যাও। সেই ক্রেতার নাম আতিক। মাত্র বিশ হাজার টাকায় সে মালয়েশিয়া নিয়ে যাবে। ফার্নিচারের দোকানদার ও তার ভাতিজা সিরাজুল ইসলাম মালয়েশিয়া যাবার স্বপ্ন দেখতে থাকে।  আতিককে ৩৫ হাজার টাকা দেয় । মেছো নৌকাতে উঠে মালয়েশিয়াতে যাবার জন্য রওনা হয়। দুইদিন ওরা সোনাদীয়া দ্বীপে থাকে। সেখান থেকে আরো ৯১ জন মানুষকে সেই নৌকাতে উঠানো হয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট ৪৮৫ জন মানুষ মালয়েশিয়া যাবার পথে সাগরে ডুবে মারা গেছে। ইউনাইটেড নেশনস এর রিপোর্ট অনুসারে প্রতি সপ্তাহে ৫০-১৫০ জন বাংলাদেশী নৌকাযোগে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়। ২০১৩ সালের নভেম্বরের তিন তারিখে ৫০ জন মানুষ মারা যায় মালয়েশিয়া যাবার পথে। ২০১৪ সালের ২০শে মে তারিখে ৬০ জন বাংলাদেশীকে উদ্ধার করা হয় সেইন্ট মার্টিন দ্বীপের কাছ থেকে। চারজন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। গত বছরের এপ্রিলে ৩৫৭ জন বাংলাদেশীকে থাইল্যান্ড সরকার গ্রেফতার করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাবার পথে। ফেব্রুয়ারীর ১০ তারিখে ২১১ জন মানুষকে উদ্ধার করা হয় এদের ভেতরে ২০ জন মহিলা ও ১৭ জন শিশু ছিল ।

৩৫ ফুট লম্বা মেছো নৌকাতে সিরাজুল ইসলাম, তার চাচা আর সাথে আরো ৯১ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়ার পথে যাত্রা করে। সাত আট দিন নৌকাতে থাকার পরে বেশীরভাগ মানুষের ডায়ারিয়া শুরু হয়ে যায়। নৌকাতে বসার জাগা ছিলনা। ঘুমাবার জাগা ছিল না। চারিদিকে এত পানি কিন্তু পান করার মত পানি ছিলনা। একদিন ওরা একটি নৌকা দেখতে পায় তখন সবাই সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকে । এই নৌকাটি এলে সবাই সেটাতে উঠে। থাইল্যান্ডের গার্ডরা একটা এলাকাতে সবাইকে নিয়ে যায়। প্রতিদিন দুইবেলা খেতে দেয়।  কিছুদিন পরে আবার যাত্রা শুরু করে। ছয়দিন যাত্রার পরে সবাইকে নৌকা থেকে নেমে যেতে বলে, লাইনে দাঁড় করিয়ে বেদম প্রহার করে। সবাইকে অন্য একটি নৌকাতে উঠতে বলে। ওরা সবাই সেই গার্ডদের কাছে আকুতি জানায় তাদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে সাহায্য করার জন্য । কিন্তু গার্ডরা ওদের মারতে থাকে এবং বলে যে তোমরা এই নৌকাতে উঠলেই মালয়েশিয়া যেতে পারবে। সেখানে আরো ৫০০ মানুষ ছিল। সবাই যার যার দেশে যাবার জন্য উৎকণ্ঠিত । থাইল্যান্ড নেভী সবাইকে চারটা নৌকাতে ঊঠায়। চারটি নৌকাতে প্রায় ১৫১ জনের মত। চারটি নৌকা থাইল্যান্ডের নেভী নৌকার সাথে দড়ি দিয়ে বাধা ছিল। এক রাত এক দিন যাবার পরে থাইল্যান্ডের নেভী নৌকা থেকে এই চারটি নৌকার দড়ি কেটে দেয়।  আর সাগরের মাঝখানে চারটি নৌকা বাতাসে দিক্বিদিক ভাসতে থাকে। সিরাজুল ইসলামরা কেউ জানতো না ওরা কোথায় ভাসছে। নেভী নৌকাটি তাদের সাগরের মাঝখানে ফেলে চলে যায়। ১১ দিন ওরা সবাই ভাসতে থাকে। খাবার ছিল না। খাবার পানি ছিলনা। ১৯ জন মানুষ মারা যায় সিরাজুল ইসলামের চাচাসহ । অনেকেই সাগরের নোনা পানি পান করে অসুস্থ হয়ে যায়। নৌকার চারিদিকে মৃতদেহ, অসুস্থ মানুষের বমি, দুর্বল আর ক্ষুধার্ত মানুষ। অনেকেই তাদের নিজেদের প্রস্রাব পান করতে থাকে।

একদিন ওরা একটা সবুজ দ্বীপ দেখতে পায়। সবাই সেদিকে ছুটে যায়। সবাই অনেক দুর্বল ছিল। হাটতে পারছিলনা অনেকেই হামাগুড়ি দিয়ে বুকে হেটে চলছিল। ভাগ্যক্রমে পানির খোঁজ পাওয়া যায়। ওরা সবাই ঘাস খেতে থাকে, গাছের পাতা, যা কিছু খাওয়া যায় সব খেতে থাকে। ১৩০ মানুষ সেই সবুজ দ্বিপে আশ্রয় নেয়। দুইদিন হাটার পরে একটা ছোট নৌকাতে ওরা কিছু লোক দেখতে পায়। তাদের কাছে সাহায্য চাইলে তারা এগিয়ে আসে। তারা ইংরেজীতে কথা বলে। তখন ওরা সবাই জানতে পারে যে তারা ভারতে এসে উপস্থিত হয়েছে। সেইসব লোকেরা একটা বড় নৌকা নিয়ে আসে। খাবারের ব্যবস্থা করে। সাগরে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করার জন্য ভারত সরকার তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে। ছয় মাসের জেল হয়। কিন্তু ওরা সবাই সেখানে নয় মাস থাকে। আন্দামান জেলে আগে থেকেই অনেক বাংলাদেশী কয়েদী ছিল। রেড ক্রশের সাহায্যে মোট ১৮৩ জন মানুষ বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারে।

উপরের ঘটনাটি কক্সবাজারের সিরাজুল ইসলাম একাত্তুরের টেলিভিশনকে জানায়। ঘটনাটি জানার পরেও একাত্তুরের টেলিভিশন দেখার পরেও হয়তো অনেক বাংলাদেশী মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্য পাড়ি জমায়। অনেকেই হয়ত একই দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হয়।  রাতারাতি ধনী হওয়া আর অনেক টাকা কামায় করার স্বপ্ন না দেখে যা কিছু বাংলাদেশে আছে তা নিয়েই সুখি হবার চিন্তাভাবনা কি করা যায়। বাংলাদেশ একটি সম্পদশালী দেশ। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন আছে তেমনি আছে সুদক্ষ মানব সম্পদ। আমাদের দেশ সম্পদশালী বলেই বিদেশীরা আমাদের দেশের  অর্থনীতি-সমাজব্যবস্থা-রাজনীতি-সাংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রন করতে চায়। আমাদের সম্পদ ব্যবহার করে আমাদের দাস বানিয়ে রাখতে চায় আর আমরা নিজেদের সম্পদশালী দেশ ফেলে অন্যদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে যেয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করি।

স্বদেশ বা প্রবাস – যে যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সহজেই সুখি হবার জন্য সবাইকে একটা সহজ কাজ করতে হবে তা হলো অপব্যয় রোধ করা ও সঞ্চয় করা। যখন সঞ্চয় করবেন তখন রাতারাতি সম্পদশালী হবার চেস্টা করবেন না। সঞ্চয় থেকে ধীরে ধীরে আয় হওয়া ভাল কিন্তু যদি বেশী আয় করতে যেয়ে প্রতারকের হাতে টাকা বিনিয়োগ করা হয় তাহলে আম ছালা দুইটাই যাবে। সঞ্চয় করুন, কস্টার্জিত পুঁজি ধরে রাখুন, বিনিয়োগের সময় মূলধনকে বাঁচিয়ে রেখে আয় বৃদ্ধি করুন। প্রতিদিন মিতব্যয়ী হতে হবে। প্রতিদিন সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিদিন সুন্দর থাকতে হবে। তাহলে তিনশত পয়ষট্টি দিন পরে আত্মবিশ্বাসের সাথে আমরা বলতে পারবো Happy New Year 2016.

২০১৫ সালের জন্য বলবো – সততার সাথে পরিশ্রম করুন, অপচয় রোধ করুন, দরকারের বাইরে ফালতু খরচা বন্ধ করুন, সব ধরনের প্রতারক থেকে সাবধান থাকুন, সতর্ক থাকুন, নিরাপদ থাকুন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন, অপরাধের পথ রোধ করুন, ভাল থাকুন, শান্তিতে থাকুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *